কোষ্ঠকাঠিন্য একটি হজমজনিত রোগ। এটা সব বয়সের মানুষের হয়ে থাকে। এর কারনে রক্ত স্বল্পতা, অবসাদ (ক্লান্তি), অনিদ্রা, চোখে ব্যথা, চোখের নিচে কালি পড়া, মাথা ঘোরা, কোমর ব্যথা, ক্রমান্বয়ে আলস্য বৃদ্ধি পাওয়া এবং মনোযোগ হ্রাস পাওয়ার মত রোগ হতে পারে। এই সমস্যা বেড়ে গেলে শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং চর্ম রোগ দেখা দিতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে এখনি ঘরে বসে খুব সহজে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের ঔষধ তৈরি করে নিন।
কোষ্ঠকাঠিন্য কি?
কোষ্ঠকাঠিন্য হল মলত্যাগের অস্বাভাবিকতা। যখন স্বাভাবিকভাবে শরীর থেকে ম্যলত্যাগ করতে এক ধরনের কষ্ট বা অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সাধারণত মানবদেহে প্রতিদিন কমপক্ষে ১ বার করে মলত্যাগের প্রয়োজন হয়। যদি ১-২ দিনে দেহ এই প্রয়োজন বোধ হওয়া সত্ত্বেও মলত্যাগ করতে না পারে সেটাই কোষ্ঠকাঠিন্য বা মল নিষ্কাশনে কঠিনতা বলে।
কোষ্ঠকাঠিন্য লক্ষণ:
কোষ্ঠকাঠিন্য হলে মল শুষ্ক, শক্ত ও কঠিন হয়ে যায়। ফলে মলত্যাগের সময় কষ্ট লাগে, মলদ্বারে ব্যথা করে, মলত্যাগে অনেক সময় লাগে, মলত্যাগে অসম্পূর্ণ মনে হয়।
কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়
নানা কারণে মানবদেহে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া কিন্তু চর্বি ও আমিশযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া, হজমক্রিয়ায় সমস্যা, ডায়াবেটিস, অলসতা, দুশ্চিন্তায় ভোগা এবং অনেক সময় ঔষধের পার্শপ্রতিক্রিয়ার কারণেও কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত চা-কফি পানের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
কোষ্টকাঠিন্য থেকে মুক্তির উপায়
চিকিৎসকদের মতে, কোষ্ঠকাঠিন্য সারানোর চেয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয় সেভাবে জীবন যাপন করা বেশি ভাল। নিয়মিত শাকসবজি খাওয়া, প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়া বিশেষকরে সকালে খালি পেটে পানি খাওয়া, চর্বি ও আমিষযুক্ত খাবারের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেয়া, সঠিক মাত্রায় ঘুম, ইত্যাদি কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে সাহায্য করে। তবে কোষ্ঠকাঠিন্য হলে দেরি না করে সাথে সাথে চিকিৎসা করা উচিত। এর জন্য নিচের কোষ্ঠকাঠিন্য ভাল করার প্রাকৃতিক ঔষধগুলো খেতে পারেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য ঔষধ
কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের কারনের শারীরিক অস্বস্তির পাশাপাশি মানসিক দুশ্চিন্তাও বেড়ে যায়। কোষ্টকাঠিন্য থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে অনেক প্রাকৃতিক ঔষধ আছে যেগুলো হজমক্রিয়াকে গতিশীল করার পাশাপাশি এই রোগ ভাল করে। আর সেগুলো খুব সহজেই ঘরে বসে তৈরি করা যায়।
গরম পানিঃগরম পানির উপকারিতার সাথে আমি তেমন পরিচিত নই। অবাক করা হলেও সত্য যে, গরম পানি কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ সাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। নিয়মিত সকালে খালি পেটে ১ গ্লাস গরম পানি পান করলে কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ হবে না। শরীরে পানির অভাব মানে ডিহাইড্রেড হবে না। এটা ত্বকের জন্যও অনেক উপকারি। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে পায়খানা নরম করতে ২-৩ ঘণ্টা পর পর ১ গ্লাস কুসুম গরম পানি পান করুন এবং হাঁটাহাঁটি করুন।
লেবু পানিঃ লেবুর রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খুব কার্যকরী। এতে থাকে পুষ্টিগুণগুলো হজমক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে মলত্যাগকে গতিশীল করে। এটা সবচেয়ে সহজ কিন্তু সর্বোত্তম পদ্ধতি। ১ গ্লাস কুসুম গরম পানির সাথে ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন। কোষ্ঠকাঠিন্য না সারা পর্যন্ত সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এবং সন্ধ্যায় এটা পান করুন।
মধুঃ পায়খানা নরম করতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে মধু খুব কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে পারে। যারা নিয়মিত ১ চা চামচ করে মধু খান তাদের কোনদিন কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ হবে না। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে দিনে ৩ বার ২ চা চামচ করে মধু খান। তবে খুব দ্রুত কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ১ গ্লাস গরম পানির সাথে ১ টেবিল মধু এবং ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন। এটাকে কোষ্ঠকাঠিন্য ভাল করার মহৌষধ বলা হয়।
উচ্চমাত্রায় আঁশযুক্ত শাকসবজিঃ শাকসবজিতে প্রচুর আঁশ বা ফাইবার আছে। এটা খুব সহজে হজম হয় এবং মলদ্বারকে শক্তিশালী করে। এছাড়াও এতে আছে প্রচুর পারিমানে পানি যা মলত্যাগের রাস্তাকে পিচ্ছিল এবং মলত্যাগের গতি বৃদ্ধি করে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, পালং শাক, শিম, শিমের বিচি মূলা, বেগুন, অন্যান্য সবুজ শাক, ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ আছে। এসব সবজি নিয়মিত খেলে হজমজনিত সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায় এবং নিয়মিত পায়খানা হয়। আধা গ্লাস পালং শাকের রসের সাথে আধা গ্লাস গরম পানি মিশিয়ে দিনে দুইবার পান করলে খুব দ্রুত কোষ্ঠকাঠিন্য সেরে যায়।
ক্যাস্টর তেলঃ ক্যাস্টর তেল দেহের অভ্যন্তরীণ ছোট ও বড় অন্ত্র বা নাড়িভুঁড়ির কর্মপ্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেয় এবং এর নাড়াচাড়াকে আরো গতিশীল করে। খালি পেটে ১ থেকে ২ চা চামচ ক্যাস্টর ওয়েল খান। সুস্বাদু করার জন্য ফলের জুস বা মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। এটা খাওয়ার কয়েক ঘন্টার মদ্ধে মলত্যাগের চাপ অনুভূত হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য ভাল হয়ে গেলে এটা খাবেন না।
তিসির বীচিঃ তিসির বিচি (Flax Seed) নানা ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ একটি খাবার। এতে আছে প্রচুর ফাইবার এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। এছাড়াও এতে মল নরম করার অনেক গুনাগুণ আছে যা কোষ্ঠকাঠিন্যের ঔষধ হিসেবে অত্যান্ত ফলপ্রসূ। ১ গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ তিসির বিচি ২-৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পানিসহ তিসির বিচি খেয়ে ফেলুন। সকালে আপনার অন্ত্রের কার্যক্রম অনেক ভাল হবে।
আঙ্গুরঃ আঙ্গুরে অদ্রবণীয় (insoluble) ফাইবার যা পরিপাকতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং হজমশক্তি দ্বিগুন করে। সারাদিন ২৫০ গ্রাম আঙ্গুর অথবা আধা গ্লাস আঙ্গুরের রস পান করুন। অথবা ১০-১২ টা বিচী ছাড়া কিসমিস দুধের সাথে কয়েক মিনিট আগুনে রেখে গরম করে নিন। তারপর কিসমিসগুলো দুধ সহ পান করুন। এটা সন্ধ্যায় করলে বেশি কার্যকরী হবে। এটা বাচ্চাদের জন্য বেশি উপকারী।
ঝোলাগুড়ের সরবতঃ শুনে অবাক হলেও, ঝোলাগুড় (Molasses) কোষ্ঠকাঠিন্য ভাল করার পাশাপাশি পায়খানা নরম করার প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে অনেক ফলপ্রসূ। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ১ চা চামচ ঝোলাগুড় খেয়ে নিন। এটাকে সুস্বাদু করার জন্য গরম দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। কোষ্ঠকাঠিন্য জটিলাকার ধারণ করলে পরিমাণ বাড়িয়ে ২-৩ টেবিল চামচ করে খান। ঝোলাগুড়ে উচ্চমাত্রায় ক্যালরি আছে তাই এটা দিনে একবারের বেশি খাওয়া ঠিক হবে না।
শুকনা খাবারঃ শুকনা খাবার যেমন, খেজুর, কিসমিস, বাদাম, আলুবোখারা, ইত্যাদিতে উচ্চমাত্রায় ফাইবার এবং টারটারিক এসিড আছে। পায়খানা নরম করতে এসব খাবার খুব উপকারি। গবেষণায় দেখা গেলে যারা নিয়মিত প্রিতিদিন এক মুঠ পরিমাণ কিসমিস খায়, তাদের পায়খানা নরম থাকে এবং হজম জনিত কোন সমস্যা হয় না।
আদা রসুন, মধুর মিশ্রণে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়প্রাকৃতিক এন্টিবায়েটিকঃ এটা আমার নিজের আবিস্কার বলতে পারেন। আমি যাদেরকে এটার পরামর্শ দিয়েছি, সবার কাজ হয়েছে। ফলাফল ১০০ ভাল। তাই আমি এর নাম দিয়েছি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার প্রাকৃতিক এন্টিবায়েটিক ঔষধ।
উপাদানঃ আদা, রসূন, চাপাতা/টিব্যাগ, মধু, লেবুর রস, গরম পানি
ধাপ ১. আদা (১ বর্গ ইঞ্চি) এবং বড় সাইজের ৩ কোয়া রসূন (ছোট সাইজের কোয়া হলে পরিমাণ মত) একসাথে ছেঁচে হালকা রস করে নিন।
ধাপ ২. এক কাপ পানি চায়ের জন্য গরম করে নিন। ইচ্ছে করলে চাপাতা সহ গরম করে নিন।
ধাপ ৩. ১টি চায়ের কাপের মধ্যে আদা-রসুন ছেঁচা এবং লেবুর রস রাখুন। এবার ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিন। সব শেষে দুই চা চামচ মধু দিয়ে ভাল করে সব একসাথে মিশিয়ে নিন।
চায়ের মত করে এটা পান করতে থাকুন। আদা-রসুনের ছোকলা চুষে রস গুলো খেয়ে নিন। রাতের মধ্যে পেট পরিষ্কার হয়ে মলত্যাগ হবে। এটা ব্যবহারের ফলে অন্যকোন সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
নিয়মিত পায়খানা হওয়ার উপায়
ক. নিয়মিত হাঁটাহাঁটি বা কায়িক পরিশ্রম করুন। সামান্য দুরুত্বে রিক্সা না নিয়ে হেটে যান। প্রতিদিন কমপক্ষে ২০-৩০ মিনিট হাঁটুন।
খ. পানি পানের অভ্যাস গড়ে তুলুন। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দৈনিক ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে। যথাসম্ভব কোমল পানীয় এড়িয়ে চলুন। কিডনি এবং হার্টে কোন সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পানি পান করুন।
গ. প্রতিদিন শাকসবজি এবং ফলমূল খান।
ঘ. ঘুম এবং খাওয়া দাওয়ায় রুটিন মেনে চলুন।
ঙ. উচ্চ কমোড (High Commode) এড়িয়ে চলুন।
চ. কমোডে বসার সময় দুই পায়ের মাঝে ৬ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা দূরত্ব রাখুন।
মনেরাখবেন, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার সব ঔষধ আপনার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। তাই শুধু নির্দিষ্ট কোন একটি সেবন না করে কয়েকটি সেবন করুন। আর এতে যদি আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য ভাল না হয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
একজন ওয়েব অন্ট্রাপ্রেনিয়ার, ব্লগার, এফিলিয়েট মার্কেটার। ২০১২ সাল থেকে অনলাইনে লেখালেখি নিয়ে কাজ করছেন। ২০১৫ সালে সঠিক ডায়েট ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ৩৪ কেজি ওজন কমিয়েছেন।
No comment yet, add your voice below!