শীতে লার্ভা অবস্থায় এডিস মশা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতে সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা বিস্তার লাভ করে।
চলুন ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো জেনে নিই-
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর সংক্রমণের ফলে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সে সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা (বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা) হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় মনে হয় যেন হাঁড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এ জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’।
জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচদিনের মধ্যে সারা শরীরজুড়ে অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো দেখতে স্কিন র্যাশ হয়। র্যাশের ফলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব দেখা দেয়। জ্বরের ফলে রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং খাওয়ার রুচি কমে যায়।
অনেকসময় শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়; যেমন : চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সাথে, রক্ত বমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে রক্ত পড়তে পারে। মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব বা রক্তক্ষরণ শুরু হলে এটি অনেক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াভহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়।
এর ফলে-
নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়ে পড়ে। শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রস্রাব কমে যায়। হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষাঃ
ডেঙ্গু জ্বরের রোগনিরূপণ মাইক্রোবায়োলজিক্যাল টেস্টিং-এর মাধ্যমে সম্ভব। জ্বর হওয়ার শুরুর দিকে রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) ও ডেঙ্গু এনএসওয়ান পরীক্ষা দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি শ্বেতরক্তকণিকা, হিমাটোক্রিট, অণুচক্রিকা, রক্তের অ্যালবুমিন, যকৃতের এনজাইম এসজিপিটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি টেস্ট করানোরও প্রয়োজন পড়ে ।
রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও এই পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দিতে হবে৷
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসাঃ
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তবে এসময় রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরের ফলে প্লাজমা লিকেজ বা রক্তের তরল অংশ কমে যায়। এতে রোগীর ব্লাড প্রেশার কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য রোগীকে নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রচুর পরিমাণে ডাবের পানি, ওরস্যালাইন, লেবুর শরবত খাওয়ান। ডাবের পানিতে খনিজ বা ইলেট্রোলাইটস আছে, যা ডেঙ্গু জ্বরে খুবই দরকারি।
বাড়িতে থাকাকালীন-
পর্যাপ্ত বিশ্রামে (জ্বর চলাকালীন এবং জ্বরের পর এক সপ্তাহ) থাকতে হবে
গ্লুকোজ, ভাতের মাড়, বার্লি, বাসায় তৈরি ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়ান।
প্যারাসিটামল ট্যাবলেট-
পূর্ণবয়স্কদের জন্য ২টি করে প্রতি ৬/৮ ঘণ্টা পর পর।
সতর্কতা-
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। কারণ এতে আকস্মিক রক্তক্ষরণের আশঙ্কা রয়েছে।
চিকিৎসা চলাকালীন রোগীকে দিনরাত সব সময় মশারির ভেতরে থাকতে হবে।
এছাড়া-
১. খুব জ্বর এলে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিতে পারেন। পানির তাপমাত্রা আপনার শরীরের তাপমাত্রার চেয়ে দুই ডিগ্রি কম হবে। বাথটাবে বা ঝরনার ধারায় গোসল করা ভালো। তবে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বেশি ভিজবেন না। গোসল সেরে দ্রুত শুকনো তোয়ালে দিয়ে পানি মুছে নিন।
২. গোসল করা সম্ভব না হলে শরীরের ত্বক স্পঞ্জ করতে পারেন। পরিষ্কার সুতির পাতলা কাপড় গামলার পানিতে ভিজিয়ে চিপে নিন। পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে (গরম বা বরফ-ঠান্ডা নয়)। এবার এই ভিজে কাপড় দিয়ে সারা শরীর মুছে নিন। ভেজা কাপড় দিয়ে মোছার পর শুকনো কাপড়ের সাহায্যে পানি মুছে নিন।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিলে ঘরোয়াভাবে যেসব খাবার খাবেন-
১. জ্বরের মধ্যে হারবাল ও গ্রিন চা বেশ উপকারি। চায়ের মধ্যে এক টুকরো আদা, এলাচি, লবঙ্গ বা খানিকটা মধু মিশিয়ে এই হারবাল চা তৈরি করা যেতে পারে। এক কাপ পানিতে দুই চামচ আপেল সিডার ভিনেগার ও এক চামচ মধু মিশিয়ে দিনে দু-তিনবার পান করুন। এটি শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে অত্যন্ত সহায়ক।
২. জ্বর হলে শরীরের বিপাকক্রিয়া বাড়ে। এতে বাড়তি ক্যালরির প্রয়োজন পড়ে। তাই এসময় সহজপাচ্য খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। ফলের রস বা ফল খেতে চেষ্টা করুন। বিশেষ করে ভিটামিন সি-যুক্ত ফল, যেমন: কমলা, মালটা, লেবু, জাম্বুরা, আনারস ইত্যাদি। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করবে।
৩. নানা ধরনের ভেষজ খাবারের উপকারিতা আছে; যেমন পেঁপে পাতা অণুচক্রিকা বাড়াতে সাহায্য করে বলে ডেঙ্গু নিরাময়ে দারুণ উপকারি। এছাড়া পেঁপে পাতায় থাকে প্রচুর পরিমাণে কমপ্লেক্স ভিটামিন রয়েছে যা জীবাণু বহনকারী মশার লার্ভা ধংস করে। পেঁপে পাতার রস সেবনে প্লাটিলেটের সংখ্যা প্রথম দিনেই বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং ৫ দিনেই প্লাটিলেটের সংখ্যা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
ডেঙ্গু নিরাময়ের জন্য পেঁপে পাতার রস কীভাবে তৈরি করবেন-
পেঁপে পাতার রস বানানোর জন্য কচি পেঁপে পাতা ধুয়ে শিরা থেকে তা ছাড়িয়ে নিতে হবে । তারপর তা পিষে রস বের করতে হবে। ২৫ মিলিলিটার বা ৫ চা চামুচ পাতার রস এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন দুই বেলা ( সকালে ও সন্ধ্যায়) দুই চামচ করে সেবন করতে হবে।
৪. নিম পাতা ভেজানো পানি পান করুন। এর ফলে প্লেটলেট এবং সাদা রক্ত কণিকার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এটি ইমিউনিটি সিস্টেমকেও অধিক কার্যক্ষম করে তোলে।
৫. এসময় ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রচুর পরিমাণে গাজর, টমেটো, শসা ইত্যাদি সবজি খেতে দিন। কেননা এতে জলীয় অংশ বেশি থাকে। ব্রকোলি ভিটামিন ‘কে’ এর অন্যতম উৎস, যা ডেঙ্গুতে রক্তপাতের ঝুঁকি কমায়।
৬. ডেঙ্গু রোগীকে প্রতিদিন নানা ধরনের স্যুপ; যেমন সবজির স্যুপ, টমেটোর স্যুপ, চিকেন স্যুপ বা কর্ন স্যুপ দিন। এতে পানির চাহিদা পূরণ হবে, পাশাপাশি পুষ্টিও নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া নরম সেদ্ধ করা খাবার, জাউ, পরিজ ইত্যাদি খাওয়ান।
৭. ডেঙ্গুর সংক্রমণের ফলে যকৃতে এসজিপিটি (SGPT: Serum glutamic pyruvic transaminase) বেড়ে যায়। তাই অতিরিক্ত মসলা ও চর্বি তেলযুক্ত খাবার খাওয়া পরিহার করুন। তবে খাদ্যতালিকায় প্রয়োজনীয় আমিষ থাকতে হবে।
যাদের জন্য ডেঙ্গু জটিল হতে পারে
শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগ জটিল হয়ে উঠতে পারে। আগে যারা আক্রান্ত হয়েছে, তারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে জটিলতা বেশি হয়। এ রকম রোগীরা সহজে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে পারে। তাই শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য দরকার বিশেষ সতর্কতা। তবে মনে রাখবেন, মাতৃদুগ্ধ পানের মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায় না।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয় কি কিঃ
বাড়ির আশপাশের ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
এডিস মশা মূলত জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের পরিত্যক্ত খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন।
খেয়াল রাখুন, যাতে অ্যাকুয়ারিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ারকন্ডিশনারের নিচেও পানি জমে না থাকে।
এডিস মশা সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তাই এসময় শরীরে ভালোভাবে কাপড় ঢেকে বের হোন। প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করুন। ঘরের দরজা-জানালায় নেট ব্যবহার করুন।
দিনের বেলায় মশারি টাঙ্গিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
বিভিন্ন রাস্তার আইল্যান্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুলের টব, গাছপালা, জলাধার ইত্যাদি দেখা যায়। এখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে। এসব জায়গায় মশার বংশবিস্তারের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
সম্ভব হলে শরীরে মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করুন।
জানালার পাশে তুলসীগাছ লাগান। এ গাছের ভেষজ উপাদান মশা তাড়ানোর জন্য খুবই উপযোগী।
মশা তাড়াতে কর্পূরও দারুণ কার্যকর। দরজা-জানালা বন্ধ করে কর্পূর জ্বালিয়ে রুমের ভেতর রাখুন। ২০ মিনিট পর দেখবেন মশা একেবারেই চলে গেছে।
শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসাঃ
শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর সংক্রমণের ফলে চোখ লাল হয়ে যাওয়া, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। ডেঙ্গুর কারণে শিশুর শক সিনড্রোম হলে পেট ফুলে যেতে পারে বা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে, যেমন রক্তবমি, পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি।
শিশুর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকরা সাধারণত কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি), এনএস ওয়ান অ্যান্টিজেন, এফজিপিটি এবং এফজিওটি ইত্যাদি টেস্ট করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
পরিস্থিতি গুরুতর হলে রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি বুকের এক্স রে, পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি, ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এছাড়া প্রস্রাব না হলে ক্রিয়াটিনিনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এ সময় শিশুদের হাত-পা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কিংবা অজ্ঞান হয়ে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থাতে চিকিৎসক বা হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে থাকা খুব জরুরি।
যদি শরীরে প্লাজমা লিকেজের কারণে ফ্লুয়িড জমতে থাকে, তাহলে স্যালাইনের মাধ্যমে শরীরে অ্যালবোমিন প্রয়োগ করা হয়। রোগী শক সিনড্রোমে চলে গেলে এই চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে।
শিশুর রক্তে প্লেটলেট যদি ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ এর নীচে চলে আসে বা রক্তরক্ষণ হয়, তাহলে শিশুকে আইসিইউ-তে রেখে প্লেটলেট দেয়ার প্রয়োজন হয়।
ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে শিশুদের ফুল হাতা ও ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখুন। যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, তাহলে বাড়িতে রেখেও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব।
উজ্জ্বল এবং মসৃণ চুল আর শারীরিক সৌন্দর্য যেন একসূত্রে গাঁথা! নিত্য আমাদেরকে চুল ফাটা, চুল ভেঙে যাওয়া, রুক্ষ হওয়াসহ চুলের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। তবে আশার কথা হলো, নিয়মিত চুলের যত্ন এবং খাদ্যাভ্যাসে সতর্কতায় আপনি পেতে পারেন সুন্দর ঝলমলে চুলের বাহার।
চুলের যত্নে লেবু
চুলের যত্নে বিভিন্ন উপায়ে লেবু ব্যবহার করতে পারেন।
লেবুর এমন কিছু ব্যবহারের কথা জেনে নেওয়া যাক-
১. ৪ টেবিল চামচ আমলকির রস ও সমপরিমাণ লেবুর রস মিশিয়ে চুলের ত্বকে ম্যাসেজ করুন। আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে ২ থেকে ৩বার এই প্যাক ব্যবহারে চুল হবে মসৃণ ও ঝলমলে।
২. খানিকটা নারকেল তেল ও লেবুর রস একত্রে মেশান। এবার মিশ্রণটি ধীরে ধীরে চুলের গোঁড়ায়স্ক্যাল্প মাখুন। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর হালকা শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। চুল ধোয়ার পর কন্ডিশনার লাগিয়ে নিন। সপ্তাহে একবার এই পদ্ধতি অনুসরণ করুন। এভাবে ছয় সপ্তাহ ব্যবহার করুন। এতে চুল পড়া বন্ধ হবে।
৩. চুল শুষ্ক প্রকৃতির হলে অথবা মাথার ত্বক ঘেমে যাওয়ার প্রবণতা থাকলে, শ্যাম্পুর সঙ্গে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে ব্যবহার করুন। এতে চুল ঝরঝরে থাকে, মাথার ত্বক ও চুল ঘেমে স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ে না, এবং ঘামজনিত দুর্গন্ধও হয় না। বাইরে যাওয়ার আগে এভাবে শ্যাম্পু করে নেওয়া ভালো, প্রয়োজনে প্রতিদিনই করতে পারবেন।
৪. তৈলাক্ত মাথার ত্বকে যদি খুশকি হয়, তাহলে ২ টেবিল চামচ মেথি, ২ টেবিল চামচ লেবুর রস ও ২ টেবিল চামচ পানি মিশিয়ে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে মাথার ত্বকে লাগিয়ে ১ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে নিন। অনেক সময় মাথায় ফুসকুড়ির মতো গোটা দেখা যায়। এ রকম সমস্যা দূর করতে এটি সপ্তাহে ২ দিন ব্যবহার করুন।
৫. ২ টেবিল চামচ আমলকির পাউডার, সমপরিমাণ মেথি পাউডার ও ১টি লেবুর খোসা (সবুজ অংশ) একসঙ্গে পেস্ট করে নিন। এরপর এক থেকে দেড় টেবিল চামচ জলপাই তেল বা নারকেল তেল মিশিয়ে মাথার ত্বকে লাগিয়ে রাখুন ১ ঘণ্টা (মাথার ত্বকের সঙ্গে সঙ্গে চুলেও দেওয়া যায়)। এরপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। সপ্তাহে এক দিন ব্যবহার করুন। এটি চুলের দ্রুত বৃদ্ধিতে দারুণ সহায়ক।
নিয়মিত লেবুর এই হেয়ার প্যাকগুলো ব্যবহারে খুশকিসহ চুলের সব সমস্যা দূর হবে। চুলের রুক্ষতা কমবে, সে সঙ্গে কমবে চুল পড়ার হারও।
চুলের যত্নে পেঁয়াজ
পেঁয়াজে প্রচুর পরিমাণে জীবাণুনাশক উপাদান থাকে। এটি চুলের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দারুণভাবে সাহায্য করে।
কীভাবে তৈরি করবেন পেঁয়াজের রস
প্রথমে পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে নিন। তারপর একে চার টুকরো করে কাটুন। এবার পেঁয়াজের টুকরোগুলো মিক্সারে ব্লেন্ড করে নিন। ব্লেন্ড হয়ে গেলে পেঁয়াজের রস ছেঁকে নিন। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে পেঁয়াজের রস চুলের গোঁড়াে লাগানোর সময় গোটা পেঁয়াজের টুকরো যেন চুলে আটকে না যায়।
পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি হেয়ার প্যাক
১. পেঁয়াজ ও মধু দিয়ে তৈরি হেয়ার প্যাক : এক কাপের এক তৃতীয়াংশ পেঁয়াজের রস নিন। তারপর এক টেবিল চামচ মধু মেশান। এবার মিশ্রণটি চুলের গোঁড়ায় ভালো করে মেখে নিন। ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
২. অলিভ অয়েল এবং পেঁয়াজের রস : অলিভ অয়েলের সঙ্গে তিন টেবিল চামচ পেঁয়াজের রস মেশান। এ মিশ্রণটি হাতে নিয়ে চারপাশ থেকে চুলের গোঁড়ায় এবং চুলের গোঁড়াে লাগিয়ে নিন। দুই ঘণ্টা রেখে কম ক্ষারযুক্ত শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। চুলের শক্তি বৃদ্ধিতে এবং খুশকি কমাতে এটি দারুণ কার্যকর।
চুলের যত্নে মধু
ঝলমলে ও সুন্দর চুলের জন্য মধু অত্যন্ত কার্যকর। চুলের যত্নের জন্য যে প্রক্রিয়ায় মধু ব্যবহার করবেন:
২০০ গ্রাম নারকেল তেলের সঙ্গে ২ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে চুলের গোড়ায় ম্যাসাজ করুন। ১ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
অথবা ১ কাপ টক দইয়ের সাথে আধা কাপ মধু মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে আধা ঘণ্টা পর ভেষজ শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
চুলের যত্নে অ্যালোভেরার ব্যবহার
অ্যালোভেরা জেলে রয়েছে ছত্রাকবিরোধী এবং জীবাণুনাশক উপাদান, যা মাথার ত্বকের চুলকানি প্রতিরোধ করে। ফলে খুশকি থেকে মুক্ত থাকে চুল। এতে বিদ্যমান বিশেষ ধরনের ময়েশ্চারাইজার আপনার চুলে প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে এবং চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে। প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলে ভরপুর অ্যালোভেরা চুলের ফলিকলকে পরিপুষ্ট করে চুল পড়া কমায়। চুল দ্রুত বড় হতেও সাহায্য করে।
অ্যালোভেরা ব্যবহারের নিয়ম
১. অ্যালোভেরার জেল সরাসরি মাথার ত্বকে এক ঘণ্টা লাগিয়ে রেখে দিন, এরপর মৃদু (মাইল্ড) শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দু-তিন দিন ব্যবহারে দারুণ উপকার পাবেন।
২. রুক্ষ চুলকে উজ্জ্বল করতে ব্যবহার করতে পারেন মধু,নারকেল তেল ও অ্যালোভেরা জেল। শুষ্ক চুলে আর্দ্রতা ফেরাতে ও চুলের ডিপ কন্ডিশনিং করতে এই উপাদানগুলো ব্যবহার করতে পারেন।
এক চা চামচ মধু, দু’ চামচ নারকেল তেল ও দু’ চামচ অ্যালোভেরা নিয়ে মিশিয়ে এক জেলের মতো উপাদান তৈরি করুন। গোসলের ৩০ মিনিট আগে এই মিশ্রণ চুলে লাগিয়ে একটা শাওয়ার ক্যাপে ঢেকে দিন মাথা। পারে আধঘণ্টা পর শ্যাম্পু করুন।
৩. চুলের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে দই ও অ্যালোভেরা ব্যবহার করুন। দু’ চামচ টক দইয়ের সঙ্গে এক চামচ অ্যালোভেরা মিশিয়ে প্রায় ১০ মিনিট ধরে মাথার ত্বকে মাসাজ করুন। পরে শ্যাম্পু করে ধুয়ে নিন চুল। এরপর অবশ্যই কন্ডিশনার লাগাবেন।
যারা নিয়মিত চুলে মেহেদি লাগান, তারা মেহেদির সঙ্গেও অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করতে পারেন ।
চুলের যত্নে ডিম
ডিমে প্রচুর পরিমাণে খনিজ, প্রোটিন এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স রয়েছে যা চুলের যত্নে দারুণ উপকারি। এটি চুল পড়া প্রতিরোধ করে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
আসুন জেনে নেই পাতলা চুল ঘন করতে ডিমের ব্যবহার-
১. একটি পাত্রে ডিম ফাটিয়ে নিন। এক টেবিল চামচ ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে নিন। ক্যাস্টর অয়েলের পরিবর্তে নারকেল তেলও ব্যবহার করতে পারেন। ভাল করে ডিম ফাটিয়ে একটা মাস্ক তৈরি করে নিন।
সপ্তাহে তিন দিন এই মাস্ক ভাল করে চুলের গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত লাগিয়ে নিন। মাথার তালুতেও ম্যাসাজও করুন। আধ ঘণ্টা পর ঠাণ্ডা পানিতে ধুয়ে শ্যাম্পু করে নিন। শ্যাম্পুর পর চুলে হালকা করে কন্ডিশনার লাগিয়ে নিন।
২. চুল সিল্কি করতে এক কাপ দইয়ের সঙ্গে একটা ডিমের কুসুম মিশিয়ে নিন। এই প্যাক চুলে লাগিয়ে ২০ মিনিট রাখুন। ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন। চুল থেকে আঁশটে গন্ধ বেরোলে হালকা শ্যাম্পু করে নিন।
৩. ঘন চুল পেতে চাইলে একটি ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে এক চা চামচ অলিভ অয়েল ঘন করে মিশিয়ে নিন। স্ক্যাল্প ও চুলে ভালো করে লাগিয়ে নিন। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর প্রথমে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে তারপর শ্যাম্পু করে নিন।
৪. ডিম দিয়ে তৈরি করতে পারেন কন্ডিশনার। একটা ডিমের কুসুমের সঙ্গে এক টেবিল চামচ অলিভ অয়েল ভালো করে মেশান। এর সঙ্গে হালকা গরম পানি মিশিয়ে পাতলা করে নিন। চুল শ্যাম্পু করার পর এই কন্ডিশনার গোটা চুলে লাগান।
ছেলেদের চুলের যত্ন
ছেলেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় ধরে জেল হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করে থাকে। এতে চুলে ময়লা, ধুলোবালি আটকে যায়। তাই দিনের বেলা যখন আপনার বাইরে কাজ করার সম্ভাবনা বেশি, তখন জেল ব্যবহার করবেন না। আর যখনই জেল বা হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করবেন, চেষ্টা করুন দ্রুত বাসায় ফিরে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলতে। শ্যাম্পু করার পর কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। কন্ডিশনার এর স্থলে এক মগ পানিতে লেবুর রস দিয়েও চুল ধুয়ে নিতে পারেন। কন্ডিশনার ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখুন কন্ডিশনার যেন চুলের গোঁড়া ও মাথার ত্বকে না লেগে থাকে।
এছাড়া যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে:
নিয়মিত চুল আঁচড়াতে হবে। এতে খুশকি হবার সম্ভাবনা কমে যাবে।
পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এতে মাথার ত্বক ও চুল ভালো থাকবে।
অতিরিক্ত চা, কফি পান পরিহার করতে হবে।
প্রতিটি চুলের গোড়ায় অক্সিজেনের প্রবেশ ও হাইড্রোজেন নির্গমনের ব্লক রয়েছে। প্রতিদিন গোসল করলে এ ব্লকগুলো সচল থাকে। চুলের বৃদ্ধিও ভালো হয়।
মাফলার, টুপি বা অন্য কোনো গরম কাপড়ের উপকরণ দিয়ে মাথা বা চুল ঢেকে রাখলে চুল ভালো থাকে।
শীতের সময় গরম পানি দিয়ে গোসল করলেও মাথায় গরম পানি দেয়া থেকে বিরত থাকুন।
মেয়েদের চুলের যত্ন
মেয়েদের সৌন্দর্য হলো চুল(Hair)। তাই নিয়মিত চুলের যত্ন নেয়া অত্যন্ত জরুরি। ব্যস্ত জীবনের মাঝে একটু সময় বের করে কীভাবে চুলের যত্ন নেবেন—তা জেনে নিই-
আবহাওয়া ও পরিবেশ বুঝে চুলের যত্ন
আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চুলের অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বৃষ্টিতে চুল ভিজলে ভেঙে যেতে পারে এবং পড়েও যায়।
এজন্য-
সপ্তাহে দুই দিন চুলে তেল লাগান। মাথায় পুরো এক ঘণ্টা তেল রেখে তবে শ্যাম্পু(Shampoo) করে চুল ধুয়ে নিতে হবে। এভাবে নিয়মিত চুলে তেল লাগালে চুল সতেজ ও কোমল থাকবে।
চুল বুঝে শ্যাম্পু নির্বাচন
কারও চুল পাতলা আবার কারও ঘন হয়। তাই চুলের ব্যালান্স বুঝে শ্যাম্পু কন্ডিশন করতে হবে। স্বাভাবিক ও রং করা চুলের শ্যাম্পু করার ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্নতা। অনেকের ধারণা, বেশি শ্যাম্পু করলে চুল পড়ে যায়। বরং চুলে নিয়মিত শ্যাম্পু করলে পরিষ্কার থাকে এবং এর স্বাভাবিক আর্দ্রতা বজায় থাকে।
শ্যাম্পুর পরিবর্তে
শ্যাম্পুর বিকল্প হিসেবে এবং রং করা চুলের জন্য মসুর ডাল বেশ ভালো কাজ করে। দুই টেবিল চামচ শর্ষেবাটা ও দুই টেবিল চামচ মসুর ডাল সারা রাত ভিজিয়ে রেখে পাতলা পেস্ট তৈরি করে নিন। এরপর পরিষ্কার মাথার চুলের গোড়ায় এই পেস্টটি ব্যবহার করুন।
কন্ডিশনারের বিকল্প চা–পাতা
বাড়িতে চা খাওয়ার পর চায়ের পাতা ফেলে না দিয়ে এটি চুলের যত্নে ব্যবহার করতে পারেন। এ চা–পাতা পানিতে ভিজিয়ে শ্যাম্পুর পর চুলে দিয়ে স্বাভাবিক পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কিন্তু এর জন্য চা তৈরির সময়ে কোনো রকম চিনি ব্যবহার করা যাবে না। তাতে চুলে আঠালো ভাব চলে আসবে।
মেয়েদের চুলের যত্নে কিছু ভেষজ তেল-
ক্যাস্টর অয়েল
ক্যাস্টর অয়েল ওমেগা ৬ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন ই-সমৃদ্ধ যা চুলকে মজবুত ও উজ্জ্বল করে। এ ছাড়া এটি নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করে। অন্যদিকে এতে ভিটামিন বি রয়েছে, যা চুলের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নারকেল তেল
চুলের যত্নে নারকেল তেলের জুড়ি নেই। নারকেল তেল ভিটামিন ই-সমৃদ্ধ। চুল এ তেল ভালোভাবে শুষে নিতে পারে। এর ফলে এই তেলের কার্যকারিতাও বেশি।
সূর্যমুখী তেল
তৈলাক্ত চুলের জন্য এ তেল খুব উপযোগী। হালকা হওয়ার ফলে চুলে ম্যাসাজ করলে, চুল তেল তেলে হয় না। তবে কখনোই চুলে সূর্যমুখী তেল বেশি সময়ের জন্য লাগিয়ে রাখবেন না। এতে চুলের গোড়া নরম হয়ে চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
চুলের যত্নে ভিটামিন ই ক্যাপসুল
ভিটামিন ই ক্যাপসুল চুলের গোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। ফলে দ্রুত বাড়ে চুল এবং নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি চুলের গোড়া মজবুত করে চুল পড়া বন্ধ করে। চুলের অকালপক্কতা প্রতিরোধে ভিটামিন-ই ক্যাপসুল দারুণ সহায়ক।
যেভাবে ব্যবহার করবেন
১. নারকেল তেলের সঙ্গে কয়েকটি ভিটামিন ই ক্যাপসুলের মিশিয়ে নিন। মিশ্রণটি রাতে ঘুমানোর আগে চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত লাগান। চুলের গোড়ায় ৫ মিনিট ম্যাসাজ করুন। পরদিন সকালে ভেষজ শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন চুল।
২. একটি কলা চটকে নিন। ৩টি ভিটামিন ই ক্যাপসুলের তেল ও ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে চুলের লাগান। ১ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। অ্যালোভেরা জেল ব্লেন্ড করে ভিটামিন ই ক্যাপসুল মিশিয়ে চুলের গোড়ায় ম্যাসাজ করুন। কিছুক্ষণ পর ধুয়ে শ্যাম্পু করে নিন।
৩. ২ টেবিল চামচ টক দইয়ের সঙ্গে কয়েকটি ভিটামিন ই ক্যাপসুলের তেল মেশান। মিশ্রণটি চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত লাগিয়ে রাখুন ৪০ মিনিট। মাইল্ড শ্যাম্পু ব্যবহার করে পরিষ্কার করে ফেলুন চুল।
বাড়তি সতর্কতা
অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন নারীর চুল পড়া ও পুরুষের টাকের সবচেয়ে বড় কারণ। এই হরমোন সাধারণত পুরুষের শরীরে বেশি পরিমাণে থাকে। নারীর মেনোপজের সময় ও পরে অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। তখন হঠাৎ চুল বেশি করে পড়তে শুরু করে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ছত্রাক সংক্রমণ বা খুশকি চুল পড়ার অন্যতম কারণ। তাই চুল ভেজা রাখা যাবে না। প্রয়োজনে চুলে ছত্রাক বিরোধী শ্যাম্পু ব্যবহার করুন।
শরীরের পুষ্টির ওপর চুলের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। দৈনিক খাদ্যতালিকায় পরিমিত পরিমাণে প্রোটিন, শর্করা, চর্বি, খনিজ ও ভিটামিন জাতীয় খাবার রাখুন। এছাড়া স্বাস্থ্যজ্জ্বল চুল পেতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিৎ।
Source:
https://www.medicalnewstoday.com/articles/321850
https://www.healthline.com/health/beauty-skin-care/regrow-hair-naturally
https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/hair-loss/diagnosis-treatment/drc-20372932
https://www.healthline.com/health/beauty-skin-care/how-to-repair-damaged-hair
এন্টিজেন জাতীয় পদার্থের প্রভাবে আমাদের শরীরে কিছু অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়; যেমন- চুলকানি, ত্বক ফুলে যাওয়া, হাঁচি, কাশি ইত্যাদি। এ সৃষ্ট উপসর্গগুলোই হলো এলার্জি।
এলার্জিতে ভোগে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। অনেকের সিজনাল ডাস্ট এলার্জি, অর্থাৎ শীতকালে বাতাসের শুষ্কতার কারণে এলার্জি হয়। আবার কেউ কেউ সারাবছরই এ সমস্যায় পড়েন। রাস্তাঘাটের ধুলোবালি, ঘরদোর পরিষ্কার করতে গিয়েও ডাস্ট এলার্জির শিকার হতে হয়।
এলার্জি কেন হয়
দেহের গঠনগত ভিন্নতার কারণে এলার্জির কারণেও বৈচিত্র্য থাকে। একেকজনের একেক কারণে এলার্জির উপসর্গ দেখা যায়। এলার্জির কারণগুলো দেখে নিই-
১. মশা, বেলেমাছি, মৌমাছি, বোলতা, ভীমরুল প্রভৃতি পতঙ্গে এলার্জির উপদান থাকে। শরীরে পশম বা পালক আছে এমন গৃহপালিত পশু (যেমন- বিড়াল, কুকুর, গিনিপিক ইত্যাদি) এবং গৃহপালিত পাখিও অনেক সময় এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে।
২. খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে এলার্জির সম্ভাবনা থাকে। কিছু সবজি, মাছ, মাংস, চকোলেট, বাদাম, পেয়াজ, আপেল, গম, ডিম, রসুন, তরমুজ ইত্যাদিতে এলার্জির উপাদান থাকে।। এমনকি ঠান্ডা পানীয়ও কোনো কোনো ব্যক্তির এলার্জির জন্য দায়ী।
৩. ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলেও এ রোগের সৃষ্টি হতে পারে। ফোঁড়া, পাঁচড়া, মাথা ব্যথা, জ্বর, শরীর ব্যথা ইত্যাদির জন্য পেনিসিলিন ও অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ আমরা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই খেয়ে থাকি। পেনিসিলিন ও অ্যাসপিরিন থেকে শরীরে এলার্জিজনিত চুলকানি হতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ সেবন করা যাবে না।
৪. দূষিত বাতাস, ধোঁয়া, কাঁচা রংয়ের গন্ধ, চুনকাম ইত্যাদি দেহে এলার্জিক বিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এতে হাঁপানি বেড়ে যাওয়ার মারাত্মক আশঙ্কা রয়েছে। যারা হাঁপানিতে ভুগছেন তাদের এগুলো পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। কোনো কোনো খাদ্য ছত্রাক দ্বারা দূষিত হয়ে থাকে। পনির, পাউরুটি এবং কেক তৈরিতে ছত্রাক ব্যবহৃত হয়। এ ছত্রাক এলার্জির অন্যতম কারণ।
৫. ঘরের ধুলোতে মাইট নামক এক ধরনের ক্ষুদ্র জীবাণু থাকে, যা শতকরা প্রায় ষাট শতাংশ ক্ষেত্রে এলার্জি সৃষ্টির জন্য দায়ী। ঝাড়ু দেয়ার সময় এবংকম্বল, পর্দা, তোষক, বালিশ, আসবাবপত্র প্রভৃতিতে যে ধুলো জমে, তা পরিষ্কার করার সময় মুখে মাস্ক বা রুমাল ব্যবহার করুন।
৬. বাবা মা কেউ এলার্জিতে আক্রান্ত থাকলেসন্তানের মাঝে এলার্জি হওয়ার অধিক আশঙ্কা থাকে।
বাতাসে (বিশেষ করে শীতকালে) যখন ফুলের রেণু বেশি থাকে তখন এলার্জির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বায়ু দূষণের পরিমাণ বেশি হওয়াতে সেখানে এলার্জির প্রকোপও বেশি।
এলার্জি জাতীয় খাবার
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় হাঁসের ডিম, গরুর মাংস, ফার্মের মুরগী, বেগুন, মিষ্টিকুমড়ো ইত্যাদি খাবার শরীরে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে থাকে। কোনো একটি খাবারে একজনের শরীরে অ্যালার্জিজনিত সমস্যা হলে, সে খাবারটি অন্যজনের শরীরেও অ্যালার্জি তৈরি করবে এমন নয়।
তবে যাদের অ্যালার্জির সমস্যা বেশি আছে, তাঁদের অ্যালকোহল, চা এবং কফি পান না করাই ভালো। কিছু কিছু খাবারে এলার্জির মারাত্মক আশঙ্কা থাকে; যেমন- দুধে, বিশেষ করে গরুর দুধে শিশুদের এলার্জি হতে পারে। এছাড়া পেয়াজ, রসুন, আপেল, আঙ্গুর, তরমুজ, চকোলেট ইত্যাদি কোনো কোনো ব্যক্তির এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে।
চলুন, এলার্জি জাতীয় কিছু মাছের কিছু তালিকা দেখে নেই-
চিংড়ি
পাঙ্গাস
বোয়াল
ইলিশ
এছাড়াও কতিপয় ছোট মাছে অনেকের এলার্জি হতে পারে। যেমনঃ পুঁটি মাছ, বেলে মাছ, শিং মাছ ইত্যাদি।
খাবারে অ্যালার্জির কারণে বেশ কিছু সমস্যা (যেমন- বমি, মাথাব্যথা, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া ইত্যাদি) দেখা দিতে পারে। কোনো খাবারে অ্যালার্জিজনিত সমস্যা হলে, সেই খাবারটি খাওয়া যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।
এলার্জিজনিত সমস্যা ও উপসর্গ
এলার্জি অত্যন্ত সংকটজনক, যা হঠাৎ শুরু হয় এবং চরম পর্যায়ে মানুষের মৃত্যুও ঘটাতে পারে। সাধারণত এলার্জেনের প্রভাবে কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার ব্যবধানে চুলকানিযুক্ত ফুসকুড়ি, গলা ফোলা, এবং নিম্ন রক্তচাপসহ বেশ কিছু উপসর্গ প্রকাশ পেতে থাকে।
চলুন, বিভিন্ন ধরনের এলার্জির লক্ষণগুলো সমন্ধে জেনে নিই-
ফুড এলার্জি
খাদ্যে এলার্জিজনিত উপসর্গগুলি হলো- ত্বক লাল হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চুলকানি, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, বমির ভাব, উদরাময় ইত্যাদি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খাদ্যের এলার্জি থেকে এনাফাইল্যাক্সিস-ও হতে পারে। এর ফলে-
দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়
জিভ, গলা এবং ঠোঁট ফুলে যায়
হাত এবং পায়ে ঝিঁ ঝিঁ করে
খাদ্যে এলার্জির কারণ-
জন্মের পরপর একাধিকবার
ডায়রিয়াজনিত রোগে ভোগা
জীবনের শুরুতেই নানাবিধ
এন্টিবায়োটিকস্ ঔষধ গ্রহণসহ
যাদের পরিপাকতন্ত্র একটু দেরিতে পরিণত অবস্থার দিকে এগোয় তাদেরও খাবারে এলার্জি দেখা দেয় এছাড়া কোনো কারণে পরিপাকতন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়াল ফ্লোরা বিপর্যস্ত হলেও ফুড এলার্জি দেখা দেয়।
এলার্জিক রাইনিটিস
ধূলিকণা, কুকুর ও বিড়ালের লোম, ছত্রাক ইত্যাদি এলার্জিক রাইনিটিসের জন্য দায়ী। নিঃশ্বাসের সাথে এ জাতীয় জীবাণু যখন নাকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, তখন নাক সংলগ্ন কান, সাইনাস এবং গলাও সংক্রমিত হয়।
উপসর্গ:
নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরা
নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া
নাকে চুলকানো
অতি মাত্রায় হাঁচি
কান ও গলা চুলকানো, খুসখুস করা ইত্যাদি।
এলার্জিক এ্যাজমা বা হাঁপানী
শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত এ সমস্যায় ফুসফুস ও এর অভ্যন্তরভাগে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ফলে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশের পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।
উপসর্গ:
প্রথম দিকে সর্দি-কাশি বা শুকনো কাশি শুরু হয়, ক্রমশ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়
নিঃশ্বাসে শো শো শব্দ হয়, দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয় ইত্যাদি।
এলার্জিক কনজাংকটিভাইটিস বা চোখের এলার্জি
শরীরের অন্যান্য অংশের মত চোখেও এলার্জির সৃষ্টি হয়। ঋতু পরিবর্তনের সময় এ ধরনের এলার্জি বেশি দেখা যায়। এছাড়া কাজল, আইলাইনার, মাসকারা ইত্যাদি প্রসাধনীও অনেক সময় চোখের এলার্জির কারণ হয়।
উপসর্গ:
সমস্ত চোখ বিশেষ করে চোখের পাতার নীচে লাল হওয়া
চুলকানির ফলে চোখ ফুলে ওঠা
চোখ ছলছল করে পানি পড়া।
হাইভস্
এলার্জিক ও নন এলার্জিক উভয় ব্যক্তির শরীরেই হাইভস দেখা দিতে পারে। বিশেষ কোন খাবার বা ওষুধের কারণে শরীরের যে কোনো অংশের ত্বকে এ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
উপসর্গ:
তীব্র চুলকানি
ত্বক লাল হয়ে ফুলে যাওয়া
এলার্জিক শক
এলার্জির কারণে শরীরের একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংক্রমিত হয়। হরমোনাল ইনজেকশন বা কোনো পোকামাকড়ের হুল দ্বারা এ ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
উপসর্গ:
দ্রুত শ্বাস নেওয়া, সাথে শো শো আওয়াজ হওয়া, গলা শুকিয়ে আসা।
নাক বন্ধ হওয়া
ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া
সমস্ত ত্বক লাল বর্ণে রূপ নেওয়া।
মুখ মণ্ডল, ঠোঁট, গলা এবং জিহ্বা ফুলে যাওয়া।
যেখান কীট-পতঙ্গ কামড়ায় বা হুল ফোটায় সেখানে চুলকানি, ছুলি এবং অবশেষ ছোট ফোসকা পড়ে, যার ভিতরে পুঁজের মতন বস্তু থাকে
বমি বমি ভাব
এছাড়া পাকস্থলী ও অন্ত্রের উপসর্গের মধ্যে পেশির সঙ্কোচনজনিত পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ইত্যাদি অন্যতম। আক্রান্ত ব্যক্তি মূত্রথলীর নিয়ন্ত্রণও হারাতে পারে, এবং নিতম্বে (pelvis) জরায়ুর সংকোচনের কারণে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। মস্তিষ্কের চারপাশের রক্তনালীসমূহের বিস্তৃতির কারণে মাথাব্যথা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এলার্জির সংক্রমণ
শ্বেত রক্তকণিকা আমাদের শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তোলে। রক্তকোষে এক ধরনের আইজি এন্টিবডি উৎপন্ন হয়। এলার্জেন(যা এলার্জির জন্য দায়ী) কোনো কারণে দেহের সংস্পর্শে এলে এটি আইজি এন্টিবডির সাথে মিশে ত্বকের নিচে, শ্বাসনালীতে, নাকে ও অন্ত্রে অবস্থিত মাস্টসেলকে ভেঙে ফেলে। ফলে মাস্টসেল থেকে হিস্টামিন, সেরোটনিন ইত্যাদি নির্গত হয়ে রক্তনালীর উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এতে এলার্জির প্রভাব দেখা দেয়।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষা
এলার্জির চিকিৎসা শুরুর আগে রক্ত পরীক্ষা করে নেয়া জরুরি। এর ফলে রক্তে ইয়োসিনোফিলের মাত্রা বেশি আছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়। হাঁপানি রোগীর ক্ষেত্রে অবশ্যই বুকের এক্সরে করে নেয়া দরকার, এটা জানার জন্য যে অন্য কোনো কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা।
আবার, স্কিন প্রিক টেস্টের মাধ্যমে রোগীর চামড়ায় বিভিন্ন এলার্জেন দিয়ে এ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে নির্ণয় করা হয় কোন কোন জিনিসে রোগীর এলার্জি আছে। স্পাইরোমেট্রি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর ফুসফুসের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এলার্জির চিকিৎসা
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে এলার্জি অনেকটা উপশম করা যায়। অনেকের ধারণা এলার্জি একবার হলে আর সারবে না। সংক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় যথাযথ চিকিৎসায় এলার্জি পুরোপুরি ভালো হয়। তবে অবহেলা করলে এবং রোগ দীর্ঘসময় ধরে থাকলে চিকিৎসা একটু কঠিন হতে পারে।
এলার্জেন পরিহার:
এলার্জির প্রধান ওষুধ হল এন্টিহিস্টামিন ও নেসাল স্টেরয়েড। এন্টিহিস্টামিন ও নেসাল স্টেরয়েডের ব্যবহারে উপসর্গ তাৎক্ষণিকভাবে প্রশমিত হয়। তবে স্টেরয়েডে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে বিধায় এ ওষুধ এক নাগাড়ে বেশিদিন ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
নিয়মিতভাবে ‘জল নেতি’ করে নাক পরিষ্কার রাখলে বাতাসে বয়ে আসা এলার্জেন থেকে বাঁচতে পারবেন।
ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপি:
এলার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপির মাধ্যমে শরীরে এলার্জির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠে। এ প্রক্রিয়ায় কোনো অ্যালার্জিক ব্যক্তির শরীরে ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপি ইনজেক্ট করে এলার্জেনের সংবেদনশীলতা কমিয়ে আনা হয়।
কিভাবে কাজ করে :
১. ইমুনোথেরাপি রক্তে আইজিই( IgE- Immunoglobulin E)’র মাত্রা ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়, যা এলার্জির জন্য দায়ী।
২. রক্তকোষে আইজিজি(IgG-Immunoglobulin G)’র মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা অ্যালার্জি প্রতিরোধ করে।
৩. হিস্টামিন নিঃসরণের পরিমাণ হ্রাস করে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ইমুনোথেরাপি’র মাধ্যমে এলার্জির চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। এটাই এলার্জিক রাইনাইটিস রোগীদের দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ থাকার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি।
এলার্জির চিকিৎসা
এলার্জিতে ফুলে যাওয়া কমাতে এলার্জি-প্রতিরোধী ওষুধ, যেমন-এন্টিহিস্টামাইনস সাহায্য করে। এন্টিহিস্টামাইনস্ হিস্টামাইন নামক রাসায়নিকের নিঃসরণকে ব্যাহত করে এবং নাক থেকে জল পড়া এবং নাক বন্ধ হওয়া থেকে মুক্তি দেয়। ডিকনজেস্টান্টস্ নাকের ভিতরের পর্দাগুলোর ফোলা কমায়। ত্বকে ফুসকুড়ির ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করার জন্য কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। যদি কারো তীব্র এলার্জিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে, তাদের হাতের কাছে এপিনেফ্রিন ইনজেকশান রাখা দরকার।
এলার্জির ভেষজ ঔষধ
চলুন, এলার্জি প্রতিরোধে কিছু ভেষজ ঔষধের ব্যবহার দেখে নিই-
নিম পাতা
নিম পাতা ত্বকের যে কোনো সমস্যা সমাধানে অনেক কার্যকর। নিম পাতা সিদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে গোসল করলে খোসপাঁচড়া চলে যায়। পোকামাকড় হুল ফোটালে নিমের মূলের ছাল বা পাতা বেটে ক্ষতস্থানে লাগালে ব্যথা উপশম হয়।
ব্যবহার: নিমপাতা রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে নিন। এক চা চামচের ৩ ভাগের ১ ভাগ নিমপাতার গুঁড়ো এবং ১ চা চামচ ইসবগুলের ভুষি ১ গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। ১/২ ঘণ্টা পর চামচ দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে, দুপুরে ভরা পেটে এবং রাতে শোয়ার আগে খান। ইনশা’আল্লাহ এলার্জির সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
তুলসী পাতা
কর্পূর সমৃদ্ধ তুলসী পাতা ত্বকের যেকোন ধরণের জ্বালাপোড়া ও চুলকানি কমাতে সহায়তা করে। তুলসির কাঁচা পাতার রস বা বিচির থেতলানের পর রস কিছুটা গরম করে সংক্রমিত জায়গায় লাগালে এলার্জি ভালো হয়। অথবা খানিকটা আদা ও তুলসি পাতা পানিতে ফুটিয়ে তাতে এক কাপ মধু মিশিয়ে দিনে ৪ থেকে ৫ বার খেলেও উপকার পাবেন।
কলা
অ্যালার্জির প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে কলা খেলে অ্যালার্জির বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। কলার চামড়ায় প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি উপাদান বিদ্যমান, যা ত্বককে ময়েশ্চারাইজড্ করে তোলে। ব্রণ দূর করার জন্যও কলার চামড়া ব্যবহার করা হয়।
লেবু
লেবুর রস মেশানো পানি এবং মধু শরীরের জন্য ভারি উপকারি ডিটক্সিফাইং পানীয়। এটি নিয়মিত পান করলে শরীরের টক্সিক পদার্থগুলো বের হয়ে আসবে এবং অ্যালার্জির সমস্যা কমে যাবে। বিশেষ করে লেবুর ভোলাটাইল তেল শরীরের যেকোন রকমের চুলকানি দূর করতে সাহায্য করে। লেবু টুকরা করে কেটে নিয়ে চুলকানির স্থানে কিছুক্ষণ ঘষুন, চুলকানি কমে যাবে।
গ্রিন টি
গ্রিন টি-তে বিদ্যমান এন্টি-অক্সিডেন্ট, এন্টি-হিস্টাসিন এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হ্রাস করতে সাহায্য করে। এটি চোখে লাল ভাব, র্যাশ বেরোনো ইত্যাদি প্রতিরোধ করে। কফি, কোমল পানীয় ইত্যাদির অভ্যাস পরিহার করুন। এর পরিবর্তে দৈনিক দু-তিন বার গ্রিন টি খান।
আদা
আদা গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল এবং অ্যালার্জির সমস্যা প্রতিরোধ করে। বমি ভাব, মাথা ঘোরানো, হজমের সমস্যা এমনকি ডায়রিয়া নিরাময়েও আদা খুব উপকারি। খানিকটা আদা কুঁচি কুঁচি করে কেটে গরম পানিতে ফুটিয়ে তাতে মধু মিশিয়ে নিয়মিত খান, এলার্জির বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাবেন।
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার
অ্যাপেল সিডার ভিনেগারে বিদ্যমান অ্যাসিটিক অ্যাসিড এলার্জেনের সংক্রমণকে প্রতিরোধ করে। ১ গ্লাস পানিতে ২ চামচ ভিনেগার মিশিয়ে নিয়মিত পান করলে এলার্জি সমস্যা দূর হয়।
ব্রোমেলিন
ব্রোমেলিন শরীরে প্রদাহ জনিত প্রতিক্রিয়া কমায়। নিয়মিত ব্রোমেলিনসমৃদ্ধ খাবার খান, এলার্জির সমস্যা লাঘব হবে।
উৎস: আনারস
জিংক
জিংকসমৃদ্ধ খাবারে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এজেন্টস্ থাকে যা এলার্জেনের প্রতিক্রিয়া হ্রাস করতে সহায়ক। ওয়েস্টার মাশরুম জিংকের সবচেয়ে ভালো উৎস। মিষ্টি কুমড়ার বীজ, শিম বীজ, বাদাম, সূর্যমুখীর বীজ ইত্যাদিতেও প্রচুর পরিমাণে জিংক রয়েছে। প্রাণিজ জিঙ্কের প্রধান উৎস হল মুরগীর মাংস। এলার্জি থেকে বাঁচতে নিয়মিত জিংকসমৃদ্ধ খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
ক্যারোটিনয়েড
ক্যারোটিনয়েড হলো উদ্ভিদের মধ্যস্থিত রঞ্জক বা রঙিন পদার্থ। এসবের মধ্যে ক্যারোটিন, বিটা ক্যারোটিন, লুটিন, লাইকোপেন, ক্রিপটোজেন্থিন এবং জিজেন্থিন থাকে যা এলার্জিক প্রতিক্রিয়ায় ভালো কাজ করে।
অনন্তমূল এক ধরনের লতানো উদ্ভিদ। এতে প্রচুর পরিমাণে স্টেরল, টার্পিন, লুপিয়ল, স্যাপোনিন ও ট্যানিন বিদ্যমান, যা এলার্জেন প্রতিরোধক। এছাড়া গাছের পাতায় ও শিকড়ে টাইলোফিরিন থাকে যা এলার্জিজনিত শ্বাসনালীর প্রদাহসহ অ্যাজমার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
ব্যবহারবিধি:
১-৩ গ্রাম মূল অথবা গাছের চূর্ণ দিনে দু’বার খাবারের পর খেলে খোস পাঁচড়া , কুষ্ঠরোগ, শ্বেতি, চুলকানিসহ সব ধরনের চর্মরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
শরীরের প্রদাহ ও ব্রণে অনন্তমূল পেস্টের মতো তৈরি করে কুমুম গরম পানি মিশিয়ে প্রলেপ দিলে দ্রুত উপশম হবে, ইনশা’আল্লাহ।
অথবা ৩ গ্রাম অনন্তমূল বেটে খানিকটা সৈন্ধবলবণ মিশিয়ে শরবতের মতো প্রতিদিন দু’বার খান। একজিমা ও হাঁপানির সমস্যা থাকলে তা সেরে যাবে।
ইউক্যালিপটাস তেল
মাথা যন্ত্রণা, নাক দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদির প্রতিকারে এক বাটি গরম পানিতে কয়েক ফোঁটা ইউক্যালিপটাস তেল নিয়ে তার ভাঁপ নিন। এতে নাক বন্ধ হওয়া, নাকের ভিতরে অ্যালার্জির কারণে কোনো প্রদাহ থাকলে তা থেকেও রেহাই মেলে।
দুগ্ধজাত পদার্থ
খাওয়ার পাতে টক দই, ছানা ইত্যাদি দুগ্ধজাত খাদ্য রাখুন। এদের প্রোবায়োটিক উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ফলে ধুলোবালির কারণে এলার্জেনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আশঙ্কা কমে।
ঘি
এক চামচ খাঁটি ঘি তুলোয় নিয়ে চুলকানির জায়গায় লাগান, আরাম পাবেন। নিয়মিত ঘি খেলেও ঠান্ডা লাগা বা এলার্জির প্রবণতা কমবে। দ্রুত ফল পেতে, ৫ থেকে ৭ ফোঁটা ঘি নারিকেল কোরায় মিশিয়ে খান।
অলিভ অয়েল
অলিভ অয়েলে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস ও ভিটামিন ই যা ত্বককে এলার্জেনের প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করে।
ব্যবহার:
খানিকটা গরম পানিতে এক কাপ এক্সট্রা ভার্জিন অয়েল, এক কাপ নারকেল তেল ও চার টেবিল চামচ মোম নিন। এরপর এতে আট ফোঁটা ল্যাভেন্ডার এসেনশিয়াল অয়েল যোগ করুন। তৈরিকৃত মলমটি প্রতিদিন আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে ম্যাসাজ করুন।
অ্যালোভেরা
অ্যালোভেরাতে প্রচুর পরিমাণে মশ্চারাইজিং ক্ষমতা রয়েছে। চুলকানির জায়গায় এক টুকরা অ্যালোভেরা কেটে ঘষুন, চুলকানি চলে যাবে। অ্যালার্জির কারণে মাঝে মাঝে ত্বকে লালচে দাগ দেখা যায়। এ দাগ দূর করতে গোসলের পানিতে অ্যালোভেরার রস মিশিয়ে ত্বকে লাগান।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস্
অনেক সময় পাকস্থলীতে প্রোটিনের আধিক্য হলেও অ্যালার্জির প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। তাই, এলার্জি প্রতিরোধে নিয়মিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ খাবার খান।
উৎস: কাঁচা মরিচ, বাঁধাকপি, আলু, বাতাবি, টমেটো, পেয়ারা, কামরাঙ্গা ইত্যাদি।
শসা এবং গাজরের রস
তাৎক্ষণিক এলার্জির সমস্যা দূরীকরণে শসা এবং গাজরের রস দারুণ উপকারি। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-এলার্জিক উপাদান বিদ্যমান, যা দেহ কোষগুলোকে এলার্জেনের প্রতিক্রিয়া রুখতে সাহায্য করে।
ক্যাস্টর অয়েল
ক্যাস্টর অয়েল শুধুমাত্র আপনার চুলের সমস্যায় নয়, এলার্জির অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধেও সহায়ক। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে এক কাপ পানিতে ৫-১০ ফোঁটা ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে খান।
আপনার শিশুকে ছোট থেকেই সব ধরনের খাবার, ফল ও সবজি খাওয়ানোর অভ্যাস করুন। এর ফলে সে খাদ্যজাত এলার্জির হাত থেকে মুক্ত থাকবে।
এলার্জি প্রতিরোধে বাড়তি সতর্কতা :
১. গোসলখানার জানালা সবসময় খোলা রাখুন, যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে। মেঝে, প্যান, বাথটাব ক্লিনার দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
২. রান্নার সময় মশলার ঝাঁঝাঁলো গন্ধ এড়াতে মুখে মাস্ক বা শুকনো কাপড় ব্যবহার করুন।
৩. ধুলোবালি থেকে বাঁচতে শিশুদের খেলনা, শোপিস, জুতা, ফ্যান, এসি, ঝাড়বাতি ইত্যাদি নিয়মিত ঝাড় দিন।
৪. গৃহপালিত পশুপাখি থাকলে তাকে নিয়মিত গোসল করান এবং থাকার জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। উচ্ছিষ্ট খাবার থাকলে তা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দিন।
৫. বিছানার চাদর, বালিশের কভার, মশারি ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার রাখুন। লেপ-কম্বল রোদে শুকিয়ে নিন, যাতে সূর্যের আল্ট্রা-ভায়োলেট রশ্মিতে হাউজ ডাস্ট মাইট মরে যায়। এক সপ্তাহ পর পর ভেজা কাপড় দিয়ে দরজা এবং জানালা পরিষ্কার করুন।
৬. রাস্তা-ঘাটে চলাচলের সময় ধুলোবালি থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করুন।
৭. উচ্চ মাত্রার সুগন্ধি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। স্প্রে করার সময়ও নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করুন।
৮. ফ্রিজের পানি এবং ঠান্ডা খাবার গ্রহণ করা যথাসম্ভব পরিহার করুন।
৯. ভিটামিন-ডি আমাদের শরীরকে এলার্জি প্রতিরোধে সক্ষম করে তোলে। তাই, সকালের রোদে দৈনিক কমপক্ষে ১/২ ঘন্টা সময় কাটান।
১০. যে কোন ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের কাছ থেকে আগে এর সাইড ইফেক্ট সম্পর্কে জেনে নিন। ভ্রমণের সময় অ্যালার্জি প্রতিরোধক মেডিসিন সাথে রাখুন।
শারীরিক সুস্থতা প্রাত্যহিক জীবনের আনন্দ উপভোগের জন্য অপরিহার্য। দেহের ক্ষয়পূরণ ও কর্মোদ্যম ফিরিয়ে আনতে পরিপূর্ণ বিশ্রামও প্রয়োজন। পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তির জন্য নিয়মিতভাবে ভ্রমণ,খেলাধুলা, বনভোজন এবং বই পড়ুন, প্রাণোচ্ছ্বল থাকুন।
সমাজের চোখে এইডস রোগীরা ব্রাত্য। এইডস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসুরক্ষিত যৌন সঙ্গম থেকে হয়ে থাকে। তবে এটাই এইডস হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। ছোট্ট শিশু এইচআইভি পজিটিভ নিয়ে জন্মায় কারণ তার বাবা-মা কেউ একজন এই ভাইরাসের ধারক। তাই, ডাক্তাররা বিয়ের আগে রক্তপরীক্ষা করা আবশ্যক বলে মনে করছেন।
তবে এইচআইভি পজিটিভ নয় এমন ব্যক্তিরাও অনেক সময় এইডসে আক্রান্ত হন। কারণ বিরল প্রজাতির কিছু ক্যানসার থেকেও এইডস হতে পারে। এটি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট আপনার সুস্থ জীবনধারাকে অস্বাভাবিক করে তুলতে পারে, এজন্য সতর্ক থাকুন।
এইডস রোগের উৎপত্তি
কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসাতে ১৯২০ সালে প্রথম এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। মূলত কঙ্গো ১৯০৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বেলজিয়ান ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ঐসময় প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ লোক রেলে কিনসাসায় যাতায়াত করতো। বিভিন্ন দেশ থেকে লোকসমাগম এবং অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনের ফলে কঙ্গোতে এইচআইভি’র সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এ রোগের বিস্তারের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও অনেকাংশে দায়ী। যুদ্ধকালীন সময়ে একই সিরিঞ্জ বারবার ব্যবহার করে আহত সৈন্যদের অনিরাপদ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়ার কারণে সংক্রমণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। আফ্রিকান দেশগুলোর অনিরাপদ যৌনপল্লীগুলোও এ ভাইরাসের সংক্রমণের অন্যতম কারণ।
১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের গবেষকরা সর্বপ্রথম এইডস এর ভাইরাস শনাক্ত করে এর নাম দেন হিউম্যান টি-সেল লিম্ফোট্রপিক ভাইরাস, সংক্ষেপে HTLV (III) । পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের গবেষকরা এ মরণব্যাধি ভাইরাসের নাম দেন ‘লিম্ফাডেনোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস’ (Lymphadenopathy Associated Virus), সংক্ষেপে ‘লাভ’ (LAV)। এর ২ বছর পর এ ভাইরাসের নতুন নামকরণ করা হয় হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (Human Immuno-deficiency Virus-HIV)।
এইচ আই ভি/এইডস সংক্রমণের তিনটি ধাপ
এইচআইভি’র সংক্রমণ তিনটি পর্যায়ে হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে এটি আপনার ইমিউনিটি সিস্টেমকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে পারে।
এই স্তরগুলি হলো –
প্রথম স্টেজ: অ্যাকিউট এইচআইভি ইনফেকশান
প্রাথমিকভাবে এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত হলেও মারাত্মক কোনো প্রভাব শরীরে পড়ে না। তবে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি এসময় ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এ শারীরিক অবস্থাকে বলা হয় রেট্রোভাইরাল সিনড্রম বা প্রাথমিক এইচআইভি সংক্রমণ। এইডসের প্রথম স্টেজে ফ্লুর মতো জ্বর হয়, আবার ১-২ সপ্তাহ পরে সেরেও যায়। এছাড়া এ স্তরে এইডস এর আরো বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়; যেমন- পেটের প্রদাহ, মাথাঘোরা, বমিভাব, ক্লান্তি, পেশীর ব্যথা, গলা ব্যথা, গাঁট ফুলে যাওয়া, শরীরের ঊর্ধ্বাংশ বা টরসোতে লাল লাল গোটা গোটা দাগ, তীব্র জ্বর ইত্যাদি। অসুরক্ষিত যৌন সঙ্গম বা অন্যান্য কারণে এইচ আই ভির ভাইরাস আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য আপনি অ্যান্টি-এইচআইভি ওষুধ খেতে পারেন। তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়, কারণ এসব পিইপি (PeP- Post-exposure Prophylaxis) ওষুধের অনেক ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
দ্বিতীয় স্টেজ: ক্রনিক এইচআইভি ইনফেকশান
এইচআইভি সংক্রমণের দ্বিতীয় স্তরকে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক বা ক্লিনিক্যালি লেটেন্ট পিরিয়ড বলে। এ সময় এইচআইভি’র সংক্রমণ বা এইডস এর লক্ষণ বোঝা যায় না। আর সে কারণেই দ্বিতীয় স্টেজ খুবই ভয়ঙ্কর। আপনি বুঝতেই পারবেন না আপনার শরীরে কতটা শক্তিশালী ভাইরাস বাসা বেঁধে আছে। আর নিজের অজান্তেই রক্তদান বা অন্য কোনো উপায়ে এইচআইভি ভাইরাস অন্যের শরীরে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে। ক্রনিক এইচআইভি ইনফেকশানের স্টেজ দশ বছর পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
এ সময় এই ভাইরাস আপনার রক্তের সি-ডি-ফোর-টি কোষের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিবে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যাবে আপনার রক্তে কি পরিমাণে এ কোষ বিদ্যমান। ইমিউনিটি সিস্টেম ভেঙে পড়ার কারণে আপনার রক্তে এই কোষের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকবে এবং আপনি আরো দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তবে সতর্কতা ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আপনি এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন।
তৃতীয় বা অ্যাডভান্স স্টেজ: এইডস
যখন কারো রক্তে প্রতি মাইক্রো লিটারে সি-ডি-ফোর-টি কোষ ২০০’র নিচে নেমে যায়, তখন ধরে নিতে হবে এটি সংক্রমণের অ্যাডভান্সড্ স্টেজ। আবার যাদের কাপোসি’স সারকোমা (Kaposi’s Sarcoma) বা ত্বকের ক্যানসার এবং নিউমোসাইটিস নিউমোনিয়া (Pneumocystis Pneumonia) থাকে, তাদের এইডস হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এসময় শরীরে ক্লান্তিভাব, গলা ও পেট ও থাইয়ের মাঝ বরাবর অংশে ফোলাভাব, দীর্ঘসময় ধরে জ্বর, রাত্রে ঘাম হওয়া, হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া, ত্বকের উপর বেগুনি রঙের দাগ, হাঁপানি, অনেক দিন ধরে ডায়রিয়া হওয়া, মুখ, গলা ও ভ্যাজাইনাতে ছত্রাক সংক্রমণ, হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ বা চোট পাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন উপসর্গ প্রকাশ পেতে থাকে।
এইচআইভি/এইডস এর সংক্রমণ
এইচআইভি ভাইরাস সিডি৪ টি লিমফোসাইট জাতীয় কোষের ভেতর আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকে। এসব কোষ সহজে ধ্বংস হয় না, কারণ এদের মেটাবলিজম বা বিপাকীয় ক্ষমতা অতি উচ্চ। তাই এগুলোই এইচআইভির মূল লক্ষ্যবস্তু।
সাধারণত বিভিন্ন বডি ফ্লুইড বা শারীরিক তরলের মাধ্যমে একজন থেকে আরেক জনের শরীরে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। রক্ত, সিমেন, ভ্যাজাইনাল ও রেকটাল ফ্লুইড এবং মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
এছাড়া অন্য যে উপায়ে এইচআইভি ভাইরাস অন্যের শরীরে প্রবেশ করতে পারে-
১। এইচআইভি সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে অ্যানাল সেক্সের মাধ্যমে। সমকামী পুরুষ যারা কোনো সুরক্ষা ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করেন তাদের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
২। অসুরক্ষিত বা অন্যের ব্যবহৃত সিরিঞ্জ অথবা সূচ ব্যবহার করলেও এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে।
৩। ট্যাটু করলে বা নাক/কান পিয়ারসিং করলে। যদি এই যন্ত্রগুলো স্টেরিলাইজ না করা হয় তাহলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
৪। কোনো গর্ভবতী মা যদি এইচ আই ভি পজিটিভ হয়, তবে জন্মের পর তার সন্তানের রক্তেও এই ভাইরাস থাকতে পারে।
৫। স্তন্যপানের সময়।
৬। এইচ আই ভি পজিটিভ আছে এমন কেউ যদি আপনাকে রক্ত দেয় তাহলেও এই ভাইরাস আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
এইডস এর প্রধান লক্ষণসমূহ
এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাব দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি কণ্ঠনালীতে ব্যথা ও শরীরে র্যাশ দেখা দেয়।
অন্যান্য রোগের মতো সুনির্দিষ্ট কোনো শারীরিক পরিবর্তন এইডস আক্রান্ত রোগীর দেহে দেখা যায়। তবে প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু উপসর্গ দেখলে আমাদের এইডস পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
যেমনঃ
দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে জ্বর থাকা।
জিভে,ঠোঁটে,গলায় ও যৌনাঙ্গে ঘা হয়ে যাওয়া।
শারীরিক ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে।
কোনও কিছু খাওয়ার সময় মুখে ও গলায় ব্যথা অনুভূত হওয়া।
শুকনো কাশি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা।
রাতের বেলা সারা শরীরে ঘাম দেখা দেওয়া।
শরীরের লিম্ফ নোড বা লাসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
দীর্ঘ সময় ধরে ডায়রিয়া থাকা।
শরীরের ওজন কমতে থাকা।
ধীরে ধীরে শরীরের অঙ্গ অকেজো হয়ে যাওয়া।
মস্তিষ্কে ক্রিপটোকোকাল মিনিঙ্গিটিস নামক এক ধরনের পরজীবির সংক্রমণ দেখা দেয়। ফলে স্মৃতিশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়া।
মুখ ও জিহ্বায় সাদা দাগ পড়ে, এমনকি মুখ বেঁকে যেতে পারে।
মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকে সমস্যা দেখা দিতে পারে। আগের তুলনায় এসময় ব্লিডিং এর পরিমাণ কম হয়।
অনেক সময় রক্ত পরীক্ষায়ও এইডসের জীবাণু ধরা পড়ে না। এইচআইভি ভাইরাস আস্তে আস্তে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়, ফলে সামান্য অসুখেও মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হয়ে পড়ে।
এইডস রোগী কতদিন বাঁচে
এইডসে আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কোনো ব্যক্তির দেহে এইডসের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিন থেকেই তার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে থাকে। কোনো রকম চিকিৎসা ছাড়া এইডস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায় ৩ বছরের মতো বেঁচে থাকতে পারেন৷ তবে অতিমাত্রায় সংক্রমিত হলে রোগী ১ বছরের বেশি সময় বাঁচতে পারেন না।
অনেকসময় কোনো রোগীর দেহে এইডসের সম্পূর্ণ বিকাশ হতে ১০ বছরের মতো সময় লাগে। বিভিন্ন এন্টি রেট্রোভাইরাল ড্রাগ ব্যবহার করে রোগীর দেহে এইচআইভি ভাইরাসের ব্যাপ্তিকাল বাড়ানো যায়। তবে সব রোগীর দেহে এসকল ঔষধ পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হয় না। এইডসে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই রোগটি সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত না হওয়ায়, নিজের অজান্তেই রোগীর দেহে এইআইভি পূর্ণমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে বর্তমান সময়ে সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণ এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিও দীর্ঘদিন সুস্থ জীবনযাপন করতে পারছেন।
ডায়াগনোসিস বা এইডস টেস্ট
এইডস রোগের সংক্রমণ নির্ণয়ের দুটি প্রধান উপায় রয়েছে। প্রথমত, রোগীর দেহে সরাসরি এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত করা, দ্বিতীয়ত, ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিগুলো শনাক্ত করার মাধ্যমে এইডস টেস্ট করা। বেশিরভাগ সময়ই রক্ত কিংবা লালার মাধ্যমে রোগীর দেহে এইচআইভির সংক্রমণ জীবাণু পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন ‘ফোর্থ জেনারেশন এইচআইভি টেস্ট’ করানো সম্ভব। আগে পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু এইচআইভি’র অ্যান্টিবডি শরীরে রয়েছে কিনা তা জানা যেত। এখন এইচআইভি অ্যান্টিবডির সঙ্গে p24 antigens-এর উপস্থিতিও নির্ণয় করা সম্ভব।
এছাড়া কেউ চাইলে ঘরে বসে নিজের দেহে এইচআইভির পরীক্ষা করতে পারেন। ‘ওরাকুইক’ নামের একটি যন্ত্রের সাহায্যে লালা পরীক্ষার মাধ্যমে এইডসের উপস্থিতির পরীক্ষা করা যায়।
এইডস এর চিকিৎসা
এইচআইভি রোগীর দেহে অন্যান্য সংক্রামক রোগ, যেমন হেপাটাইটিস বি বা যক্ষা ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। অনেকসময় নার্ভের সমস্যা, হার্টের সমস্যা বা ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগও দেখা দেয়। এমনকি গনোরিয়া, ক্ল্যামেডিয়া, সিফিলিসের মতো মারাত্মক যৌনরোগেও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এইচআইভি’র চিকিৎসা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার উপরে। যদি রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে তবে তাকে নানা ধরনের অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়।
# পরিমিত পরিমাণে সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে৷ যেসব খাবার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, সেগুলি এড়িয়ে চলুন; যেমন: কাঁচা মাংস। যথাসম্ভব রান্না করা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।
# নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
# পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নিন।
এইডস রোগীর জন্য বন্ধুবান্ধব, পরিবার এবং সমাজের মানুষদের মানসিক সমর্থন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
এইডস এর ঔষধ
ফিউশন ইনহিবিটর্স এইডস এর চিকিৎসায় খুবই কার্যকরী ওষুধ যা শরীরের CD4 কোষগুলোতে এইচআইভি ভাইরাস প্রবেশে বাধা দেয়। এইচআইভি অতি অভিযোজনক্ষম হওয়ায় এটি সরাসরি দেহের টি-সেলগুলোকে সংক্রমিত করে এবং এসব সেলের প্রোটিন গ্রহণ করে স্বল্পসময়েই বংশবিস্তার করে। ইসিডিফোর-এলজি ওষুধ কোষের অভ্যন্তরে থাকা প্রোটিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এইডস এর চিকিৎসায় জিডোবোডিন, ল্যামিবোডিন, নেভিরাপিন, টেনোফোবিন ইত্যাদি ওষুধ প্রেসক্রাইভ করে থাকে।
এইডসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত আরো কিছু অ্যান্টিবায়োটিকস্:
এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষ যেমন হেলপার টি সেল, মনোসাইট, ম্যাক্রোফেজ, ডেনপ্রাইটিক সেল, চর্মের ল্যাঙ্গারহেন্স সেল, মস্তিষ্কের গ্লায়াল সেল ইত্যাদিকে আত্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে এগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। তখন যে কোনো সংক্রামক জীবাণু সহজেই এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে।
এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধে মূলত দু’ধরনের ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হয়। প্রথমটি হলো প্রিভেন্টিভ বা প্রতিরোধমূলক ভ্যাক্সিন। এটি এইচআইভি নেগেটিভ ব্যক্তিদের জন্য। মৃত এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করিয়ে অ্যান্টিবডি উৎপাদনের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তোলা হয়। আর অন্যটি হলো থেরাপিউটিক ভ্যাক্সিন, যা আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং রোগের বিস্তারকে বাধাগ্রস্ত করবে। এই ভ্যাক্সিনগুলো শরীরের সংক্রমিত হওয়া কোষগুলো খুঁজে বের করে এবং তাদের কপি বা প্রতিলিপি তৈরি করতে বাধা দেয়।
যুক্তরাজ্যের একটি সফল গবেষণায় দেখা যায়, এইচআইভি ভাইরাসমুক্ত একজন সুস্থ মানুষের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেও এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহকে সফলভাবে এইডসের ভাইরাসমুক্ত করা যায়। প্রক্রিয়াটি এইডস রোগের ভবিষ্যৎ চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতি সাধনের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এইডস প্রতিরোধে করণীয়
এইচআইভির প্রতিরোধের মূল উপজীব্য হলো শিক্ষা, সচেতনতা, ঝুঁকির মাত্রা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা। মানুষের চিন্তায় এবং আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এইডস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে। বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলুন। এবং একাধিক যৌন সঙ্গী পরিহার করুন। নিরাপদ যৌনক্রিয়ার অভ্যাসের মাধ্যমে অসংক্রমিত মানুষ এইচআইভি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
পাশাপাশি ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ড্রাগ নেয়া থেকে বিরত থাকুন। সূচ, সিরিঞ্জ, ব্লেড বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি একাধিকবার ব্যবহার পরিহার করতে হবে। রক্ত গ্রহণ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের পূর্বে অবশ্যই জেনে নিতে হবে দাতা ব্যক্তি এইচআইভি নেগেটিভ কিনা। যৌনরোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কেউ যৌনরোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা নিন।
এইচআইভি আক্রান্ত মায়ের থেকে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার অনেকখানি আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সন্তান নেয়ার পূর্বে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা সম্পন্ন করুন। তবে যেসব মায়েরা থেরাপি গ্রহণ করেন, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তান আক্রান্ত হওয়ার হার খুবই কম। যেসব মহিলা এইডসে আক্রান্ত, ডাক্তারগণ তাদের সন্তানদেরকে বুকের দুধ পান করানোর ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করেন।
জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রতিরোধমূলক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এইচআইভি পজিটিভ হলেই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটবে না, তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একজন রোগী দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারবেন। রোগীর আশা ও আত্মবিশ্বাস এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।
এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের ভূমিকা
এইডস প্রতিরোধে সচেতনতাই হতে পারে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দিতে পারেন।
যেমন:
এইচআইভি/এইডস ও অন্যান্য যৌনরোগ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য বিভিন্ন বিষয়ে সন্তানদের খোলামেলো আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করুন।
জীবনভিত্তিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আত্ননির্ভরশীল করে গড়ে তুলুন ও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিন।
নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখুন এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিন।
স্ব-স্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ, অনুশাসন ও আদেশ মেনে চলার পরামর্শ দিন।
পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত এইচআইভি ও এইডস বিষয় ও এ সংক্রান্ত বইপত্র/পুস্তিকা সংগ্রহ করে পড়তে উৎসাহিত করুন এবং আলোচনায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিন।
যুবসমাজের উপযোগী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন।
এইচ আই ভি/এইডস কখন সংক্রমিত হয় না:
১। এইচআইভি ভাইরাস বাতাস বা পানির মাধ্যমে ছড়ায় না।
২। কোনো এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে।
৩। এইডস রোগীর সঙ্গে করমর্দন করলে বা তাকে জড়িয়ে ধরলে।
৪। এইচ আই ভি পজিটিভ কারো সঙ্গে এক টেবিলে বা এক থালায় খেলে বা তার গ্লাসে কোনো পানীয় পান করলেও এইডস হয় না।
৫। এইডস রোগীর তোয়ালে, বিছানা বা বালিশ ব্যবহার করলেও এইডস হয় না।
৬। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত ওয়াশরুম ব্যবহার করলে।
বাংলাদেশে এইডস এর চিকিৎসা
এইচআইভি সংক্রমণ শুধু একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়, বরং আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক ও মানসিক প্রভাব প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার অনেক কম; মোট জনসংখ্যার ০.১ শতাংশ। তবে নতুন রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বস্তিতে বসবাস করা জনগোষ্ঠী এইচআইভি আক্রান্তের ঝুঁকির তালিকায় রয়েছেন। এখন নারী-পুরুষ যৌনকর্মী ছাড়াও বিবাহিত দম্পতিদের মাধ্যমেও এ রোগের বিস্তার ঘটছে। নারীদের মধ্যে এইচআইভি ছড়িয়ে পড়াকে বৈশ্বিকভাবে মহামারীর অশনি সঙ্কেত হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে এইডসের বিষয়ে নজরদারির সুযোগ একদমই সীমিত।
তাছাড়া লাখ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপে অভিবাসী হয়েছেন। তারা সেখানে প্রধানত কায়িক শ্রম করেন। অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ অনেক বেশি। অজ্ঞতার কারণে এইডসে আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে তারা অনুতপ্ত হন।
বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইডস রোগী পাওয়া যায়। এরপর এইডস রোগী প্রতি বছর ধীরে ধীরে বাড়ছে। সুইস রেড ক্রিসেন্টের তত্ত্বাবধানে ২০০৫ সালে বেসরকারিভাবে সর্বপ্রথম দেশে এইচআইভি/এইডস রোগীদের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা শুরু হয়। এরপর উন্নয়ন সহযোগী গ্লোবাল ফান্ড এবং সেভ দ্যা চিলড্রেন এবং বিভিন্ন এনজিওর আর্থিক সহায়তায় এ কাজ চলতে থাকে। তবে তারা মূলত এইডস রোগী ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোর কাছে ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়ার কাজ করতো। সে সময় এনজিগুলোর শুধু ওষুধ সরবরাহ করতে ব্যয় হতো প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
সরকারিভাবে ২০১৬ সাল থেকে এইডসের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন পরিচালিত হচ্ছে। একই বছর থেকে এসব কর্মসূচী সরাসরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এএসপি কর্মসূচির মাধ্যমে পরিচালিত হতে শুরু করে। এতে বিপুল পরিমাণ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। আর রোগীরাও আগের তুলনায় বেশি সেবা পাচ্ছেন। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে খরচ আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। পাশাপাশি বেড়েছে সেবার পরিধি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এইডস মুক্ত হবে বাংলাদেশ।
এ কর্মসূচির আওতায় বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সিলেট, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে রোগীদের নিয়মিত ওষুধ ও চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
‘প্রিভেনশন মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন (পিএমটিসিটি)’ প্রকল্পের আওতায় শুধু বিএসএমএমইউ-তে এইডসে আক্রান্ত ৬৪ জন রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ৫২ জন মা সন্তান প্রসব করেছেন। নবজাতকদের ৫০ জনই এইচআইভি মুক্ত, ১ জন এইচআইভি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এবং একজন মারা গেছে। এছাড়া একই সময়ে সিলেটে ২৬ জন অন্তঃসত্তার মধ্যে ২৪ জন এইচআইভিমুক্ত সুস্থ সন্তান প্রসব করেছেন।
এইচআইভি/এইডস নির্মূলে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ইতিবাচক মনোবৃত্তির পরিচর্যা, উন্নত মননশীলতা এবং সুকুমারবৃত্তির অনুশীলন একান্তই জরুরি। নারী বা পুরুষ, যে কেউ এইচআইভি সংক্রমিত হলে, তাকে ভয় পাওয়া, ঘৃণা করা বা তার কাছ থেকে দূরে থাকা উচিৎ নয়। তার প্রতি সমবেদনা জানানো, যত্ন করা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আসুন আমরা ঐক্যের হাত তুলি, এইচআইভি প্রতিরোধ করি।
প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারীর নিয়মিত ও সময়মতো মাসিক হওয়াটা সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। তবে যৌবনের প্রারম্ভে ও শেষে কারো কারো অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে। মাসিকচক্র নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনেক মেয়ে দিনের পর দিন গোপনে মাসিকের সমস্যায় ভুগে, লজ্জায় কাউকে বলতে চায় না। এতে বরং নিজেরই ক্ষতি হয়। তাই, হীনমন্যতা এড়িয়ে ভয়কে জয় করে স্বাস্থ্যসুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন হোন, আর গড়ে তুলুন উৎকণ্ঠামুক্ত জগৎ।
মাসিক বন্ধ হওয়ার কারণ কি কি
পিরিয়ড বন্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস। আবার অতিমাত্রায় ব্যায়াম করার ফলে শরীরে হরমোন ক্ষরণে তারতম্য ঘটে; যা প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। দৌড়বিদ, সাতারু প্রমুখের ক্ষেত্রে অনেক সময় এজন্য পিরিয়ডে দেরি বা মিস হয়।
মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থির পাশে অবস্থিত হাইপোথ্যালামাস পিরিয়ডের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অতিরিক্ত মানসিক চাপে হাইপোথ্যালামাসের এই কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যার ফলে পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দেয়। সম্প্রতি যদি আপনার জীবনে এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকে, যেমন- কারও মৃত্যু, ব্রেক-আপ, চাকরি না পাওয়া, কাজের চাপ ইত্যাদি, তবে পিরিয়ডে বিলম্ব হতে পারে।
এমনকি পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের কারণেও পিরিয়ড পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। PCOS এর জন্য মুখে এবং গায়ে অতিরিক্ত লোম, ব্রন, তলপেট ব্যাথা, গর্ভধারণে সমস্যা ইত্যাদি দেখা দেয়। এটি অত্যাধিক রজস্রাবের জন্যও দায়ী। অনেকের আবার ওভারিতে সিস্ট হয়। এসব জিনগত সমস্যার জন্য মহিলাদেরকে পিরিয়ডে নানানরকম অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়।
থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার জন্যও হরমোন নিঃসরণ বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে পারে। এজন্য পিরিয়ডে বিলম্ব হয়। সাথে মানসিক অবসাদ, অতিরিক্ত চুল ওঠা, ওজন বৃদ্ধি এবং সবসময় ঠান্ডা লাগছে মনে হওয়া; এরকম কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে।
অবিবাহিত মেয়েদের মাসিকে সমস্যার কারণ
অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত মাসিক হলে গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া এতে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকিও থাকে। খাদ্যাভ্যাসে কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ বেশি হওয়া এবং ওজন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ। বয়ঃসন্ধির শুরুতে সাধারণত ১২-২০ বছর বয়সে অনেকের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্ট্রেরন হরমোনের অভাব থাকে। এ কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। অনেকসময় এসব হরমোনের ঘাটতির ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া জন্মগত ত্রুটির কারণেও পিরিয়ড অনিয়মিত হয়।
একমাসে দুইবার মাসিক হওয়ার কারণ
মানসিক চাপ অথবা অতিরিক্ত ব্যায়ামের ফলে কিংবা শরীরে কোন হরমোনাল সমস্যা থাকলে মাসে ২ বার পিরিয়ড হতে পারে। Contraceptive pills সেবনের কারণেও এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
তবে মাসিক যদি নির্দিষ্ট সময়ের দুই অথবা তিন দিন আগে বা পরেও হয় ভয় পাবেন না। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে নির্দিষ্ট দিনের সাথে যদি ছয় দিনের গ্যাপ থাকে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণ কি
বছরে একবার বা দু’বার অনিয়মিত পিরিয়ড মোটামুটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এ ঘটনা যদি বারবার ঘটতে থাকপ তবে একে গুরুত্বের সাথে দেখা দরকার। এটি কেবল আপনার সামাজিক জীবনকেই নষ্ট করবে না, বরং আপনার দৈনন্দিন রুটিন-ওয়ার্কেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে।
চলুন দেখে নিই কি কি কারণে অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে-
উচ্চ রক্তচাপ
পিরিয়ডের সময় উচ্চ রক্তচাপ ডিম্বস্ফূটনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এর ফলে ইস্ট্রোজেন এবং অন্যান্য প্রজনন হরমোন উৎপাদনেও বিঘ্ন ঘটে। এতে গর্ভাশয় স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয় না, এবং মাসিক নির্দিষ্ট সময়ে হয় না।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ
কম অ্যান্টিঅক্সিডেন্টপূর্ণ খাবার মহিলাদের হরমোনের স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে নষ্ট করে দেয়। এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ফলে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিগুলোর কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। এর ফলে কর্টিসোল বৃদ্ধি পেতে পারে; যা অনিয়মিত মাসিকচক্রের জন্য দায়ী।
অতিরিক্ত ভারি ব্যায়াম
অতিরিক্ত ব্যায়ামের ফলে পিরিয়ড ইরেগুলার হতে পারে। যারা রেসার, হেভি ওয়েট লিফটিং করেন বা অন্যান্য কারণে নিয়মিতভাবে কঠিন পরিশ্রম করেন, তারা এই সমস্যায় ভুগতে পারেন। কারণ অতিরিক্ত এক্সারসাইজ ইস্ট্রোজেন লেভেল কমায়। এতে পিরিয়ডও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত ব্যায়াম বা পরিশ্রমের ফলে থাইরয়েড এবং পিটুইটারি গ্রন্থিগুলির স্বাভাবিক কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এটি অনিয়মিত পিরিয়ডের অন্যতম কারণ।
মানসিক চাপ
মস্তিস্কে রয়েছে হাইপোথ্যালামাস নামের একটি বিশেষ অংশ, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত নিঃসরিত হয় নানা ধরনের হরমোন। এর মধ্যে কিছু হরমোন রয়েছে, যা নারীদেহে মাসিকের জন্য প্রভাবকের কাজ করে। কিন্তু অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভুগলে অনেক সময় হাইপোথ্যালামাস ঠিকমতো কাজ করে না। যার ফলে মাসিক শুরু হতে দেরি হয়।
থাইরয়েড
থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অবস্থান আমাদের গলার নিচে। এটি শরীরে মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি দেহের অভ্যন্তরীণ কাজে সাহায্য করে। থাইরয়েড গ্রন্থির যে কোন সমস্যার কারণে আপনার মাসিক অনিয়মিত হতে পারে।
জন্ম নিয়ন্ত্রক পিল
জন্ম নিয়ন্ত্রক পিল সেবন পিরিয়ডের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এটি মাসিক চক্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিরিয়ড সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বিবাহিত নারীরা হঠাৎ জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বন্ধ করে দিলে বা বার বার ওষুধ পরিবর্তন করলেও পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। কিছু কিছু জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতি, যেমন- IUD-এর প্রভাবেও পিরিয়ড দেরি বা মিস হতে পারে। আবার হঠাৎ করে এসব জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার বন্ধ করলেও স্বাভাবিক পিরিয়ড ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে যদি পিরিয়ড দেরি বা মিস হয় তবে এতে চিন্তার কোন কারণ নেই।
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম
ডিম্বাশয়তে ছোট্ট ছোট্ট সিস্টের উপস্থিতি-ই হলো পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম। এর কারণে মহিলারা অনিয়মিত মাসিক চক্রের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এজন্য প্রতি মাসে ওভারি থেকে ডিম্বাণু নির্গমন হয় না। ডিম্বাণুগুলো ওভারিতে সিস্ট তৈরি করে এর চারপাশে জমা হয় এবং শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে মাসিক সময় মত হয় না। কখনো কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ওজন কম বা বেশি হওয়া
শরীরের BMI ১৮ বা ১৯-এর নিচে নেমে গেলে, কম চর্বির কারণে আপনি অনিয়মিত পিরিয়ড অনুভব করতে পারেন। চর্বি দেহে ইস্ট্রোজেন তৈরি করতে সহায়তা করে, যা ডিম্বাশয়ের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের জন্য উপযোগী। ওজনে অতিরিক্ত তারতম্য ঘটলে পিরিয়ডের উপর প্রভাব পড়ে। আবার অতিমাত্রায় স্থূল নারীদের ডিম্বাশয়ের চারপাশে ফ্যাট জমেও ওভুলেশন-এ সমস্যা হয়। এজন্য পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
অন্যান্য চিকিৎসাগত শর্তাবলী
ডায়াবেটিস, ফাইব্রোইয়েড, এন্ডোমেট্রিওসিস এবং যৌন সংক্রামিত রোগের জন্যও একজন মহিলা অনিয়মিত পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। রুমাটয়েড-আর্থ্রাইটিসকেও অনিয়মিত পিরিয়ডের জন্য দায়ী করা হয়। এরকম অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
বয়সঃ কম বয়সে স্বাভাবিক কারণেই পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। বয়সের সাথে মহিলাদের মাসিক চক্র নিয়মিত হয়ে যায়। এজন্য কিশোরী বয়সের অনিয়মিত পিরিয়ডের জন্য চিন্তিত হওয়া যাবে না। এসময় অভিভাবকদের উচিৎ, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে মেয়েকে সচেতন করে তোলা।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাঃ অনিয়মিত মাসিক-এর আরেকটি প্রধান কারণ হলো অসুস্থতা। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং নানান রোগব্যাধি শরীরে চেপে বসে। এতে নির্দিষ্ট সময়ে মাসিক হয় না।
প্রি-মেনোপজঃ সাধারণত ৫০ বছর থেকে মেনোপজ হয় বা একবারে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। ৪০ থেকে ৪৫ বছর থেকেই মেনোপজের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। এ পর্যায়কে প্রি-মেনোপজ বলে। এ সময়েও পিরিয়ড অনিয়মিত হয়।
ব্রেস্ট ফিডিংঃ ব্রেস্ট ফিডিং-কে বলা হয় ন্যাচারাল কন্ট্রাসেপ্টিভ বা প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। যেসব মায়েরা বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের পিরিয়ড সাধারণত বন্ধ থাকে বা অনিয়মিত হয়। সদ্যজাত শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময় মূলত প্রোল্যাকটিন হরমোনের প্রভাবে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে থাকে।
দৈনিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তনঃ ভ্রমণ বা কাজের সময়ের পরিবর্তন ইত্যাদির জন্যও পিরিয়ডে দেরি বা মিস হতে পারে। তবে এটা সাময়িক; এতে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই। এছাড়া নতুন কোন ঔষধ খেতে শুরু করলেও পিরিয়ড দেরি বা মিস হতে পারে।
নিয়মিত পিরিয়ড না হলে অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এক মাসে হলে দেখা যায় আরেক মাসে হয় না। অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো দুই-তিন মাস পরপর পিরিয়ড হয়। কখনো অল্প রক্তপাত হয়, আবার কখনো অনেক বেশি। এতে সন্তান ধারণ ক্ষমতা হ্রাস প্রায়। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণেরও কারণ হতে পারে অনিয়মিত মাসিক। এজন্য অনেক সময় মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে এবং অস্বস্তি বোধ হয়।
অনিয়মিত পিরিয়ড কি গর্ভাবস্থাকে প্রভাবিত করে?
অনিয়মিত পিরিয়ড মানে আপনার প্রতি মাসে ঠিকভাবে ডিম্বস্ফূটন হচ্ছে না। এটি আপনার প্রজনন স্বাস্থ্যের বিকাশে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে অনেক মহিলা সারাজীবনের জন্য মা হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। আপনার অনিয়মিত বা অনিশ্চিত পিরিয়ড যদি হরমোনাল হয়, তবে আপনাকে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
মাসিক বন্ধ হওয়ার চিকিৎসা
৬ মাসের বেশি সময় ধরে যদি মাসিক না হয় অথবা বয়স ১৬ পার হওয়ার পরেও মাসিক শুরু না হয়, তবে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ। এ বিষয়ে সতর্ক না হলে শরীরের গ্রোথ হরমোন উত্পাদনে ব্যাঘাত ঘটবে এবং দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। কোন কোন মহিলার জন্মগতভাবে যোনিতে ত্রুটি থাকে। এজন্যও মাসিক অনিয়মিত হয়।
আবার মাসিকের আগে বা পরে হরমোনের কারণে স্তন ব্যথা হতে পারে। এজন্য মাঝে মধ্যে পেইন কিলার খেতে পারেন। স্তন ব্যথাকে স্বাভাবিক ধরে নিলেই ভালো। মাসিক অনিয়মিত হওয়ার জন্য আপনাকে কিছু হরমোন টেস্ট করাতে হবে। আমাদের দেশে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ জন মহিলার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মাসিক আরম্ভ হয় না।
অতিরিক্ত ওজন আপনার মাসিক অনিয়মিত হওয়ার জন্য দায়ী। অনেক সময় ওভুলেশন ঠিকমতো না হলে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। এজন্য একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের বা অ্যান্ডোক্রাইনোলজিস্টের তত্ত্ববধানে হরমোন পরীক্ষা করে তদানুযায়ী ওষুধ সেবন করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
অনিয়মিত মাসিকের সমস্যার জন্য কিছু ওষুধ (অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করা বাঞ্ছনীয়) –
Carbonica
Amenorrhea
Aconitum n.
Viburnum op.
Ferrum meta.
Natrum
মাসিক হওয়ার প্রাকৃতিক উপায়
পিরিয়ড নিয়মিত করতে চিকিৎসকেরা সাধারণত হরমোন থেরাপি দিয়ে থাকেন, যা আমরা খাবার পিল হিসেবে চিনে থাকি। কিন্তু এসব পিল-এর অনেক ধরনের সাইড ইফেক্ট থাকে। মোটা হয়ে যাওয়া, খাবারে অরুচি, পিম্পলস, মাথা ব্যথা, পা ব্যথা, পেট ফাঁপা ইত্যাদিসহ নানান অসুবিধা দেখা দিতে পারে। মাসিক অনিয়মিত হলে দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। হঠাৎ করে আপনার মাসিক অনিয়মিত হওয়া শুরু করলে সেটিকে নিয়মিত করার সহজ কিছু ঘরোয়া উপায় রয়েছে।
চলুন দেখে নিই, অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দূর করে তাড়াতাড়ি মাসিক হওয়ার কিছু ঘরোয়া সমাধান-
কাঁচা পেপে:
কাঁচা পেপে পিরিয়ড রেগুলেশন-এ সাহায্য করে। এটি জরায়ুর মাসল ফাইবার কন্ট্রাকশনের জন্যও উপকারি। পর পর কয়েক মাস নিয়মিত কাঁচা পেপের রস খেলে পিরিয়ড নিয়মিত হয়। পিরিয়ড নিয়মিত করা ছাড়াও কাঁচা পেপে হজমে সাহায্য করে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং ত্বক মসৃণ রাখে। তবে পিরিয়ড চলাকালীন এটি না খাওয়াই ভালো। গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকায় গর্ভকালীন সময়েও পেঁপে খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
কাঁচা হলুদ:
হলুদ পিরিয়ড নিয়মিত করতে সাহায্য করে। এছাড়া হলুদ প্রাকৃতিকভাবে আমাদের শরীরের হরমোনগুলির ভারসাম্য বজায় রাখে। কাঁচা হলুদ জরায়ুর মাংসপেশী সঙ্কোচন-প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান পিরিয়ড-এর ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এক কাপ দুধে চা চামচের চার ভাগের এক ভাগ কাঁচা হলুদ নিয়ে মধু বা গুড় মিশিয়ে কিছুদিন খেয়ে দেখুন, পরিবর্তন নিজেই টের পাবেন।
অ্যালোভেরা:
অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী রূপচর্চার পাশাপাশি মাসিক নিয়মিতকরণেও দারুণ কার্যকর। এটি হরমোন রেগুলেশনে সাহায্য করে। সব থেকে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য প্রতিদিন সকালে খালি পেটে তাজা অ্যালোভেরা পাতার রস সামান্য মধুর সাথে মিশিয়ে খান। তবে পিরিয়ড চলাকালীন না খাওয়াই ভালো।
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার:
রক্তে ইনসুলিন ও সুগার-এর তারতম্যের কারণেও মাসিক অনিয়মিত হয়। এক গ্লাস পানিতে ২ চা চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে প্রতিদিন ২ বার করে খান। আপনার পিরিয়ড সাইকেল নিয়ন্ত্রণে এটি সাহায্য করবে। পাশাপাশি রক্তে ইলসুলিন এবং ব্লাড সুগার এর মাত্রা কমিয়ে আপনাকে বাড়তি সুরক্ষা দিবে।
আদা:
১ কাপ পানিতে ১ চা চামচ পরিমাণ মিহি আদা কুঁচি নিয়ে ৫-৭ মিনিট ফুটিয়ে নিন। এরপর এতে সামান্য চিনি বা মধু মিশিয়ে নিন। প্রতিদিন খাওয়ার পর এই পানীয়টি তিন বেলা খাবেন। আদা পিরিয়ড সাইকেল রেগুলেশনে সাহায্য করে এবং অনিয়মিত পিরিয়ড নিয়মিত করে। পাশাপাশি সর্দি-কাশি থাকলেও আদা খাওয়ার ফলে তা দূর হয়ে যায়।
দারুচিনিতে হবে জাদু:
পিরিয়ডকে নিয়মিত করতে দারুচিনি দারুণ উপকারি। দারুচিনি ব্যবহারে পিরিয়ডজনিত ব্যথা থেকেও আপনি মুক্তি পেতে পারেন।এক গ্লাস দুধে ১/২ চামচ দারুচিনি গুঁড়ো যোগ করুন। সাথে খানিকটা মধু মিশিয়ে নিন। ৪-৫ সপ্তাহ নিয়মিত এই মিশ্রণ পান করুন। পিরিয়ড নিয়ে সমস্যা কেটে যাবে। অনিয়মিত পিরিয়ড দূর করতে চা বা লেবুর রসের সাথেও দারুচিনি গুড়া করে মিশিয়ে খেতে পারেন।
আঙুর:
আঙুর ফলও পিরিয়ড রেগুলার করার জন্য খুবই কার্যকরী। প্রতিদিন আঙুরের জুস খেলে বা খাবারের তালিকায় আঙুর থাকলে ভবিষ্যতে মাসিকে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
লেবুর রস:
পিরিয়ড আসার এক বা দুই সপ্তাহ আগে এক গ্লাস লেবুর রস খালি পেটে পান করুন। তবে লেবুর রসে পানি মেশানো যাবে না। চাইলে আপনি এতে লবণ যোগ করতে পারেন। মাসিক নিয়মিত করতে এটি দারুণ ফলদায়ক।
শশা এবং তরমুজ:
শশা এবং তরমুজ খুব ঠান্ডা জাতীয় ফল। এক সপ্তাহ যাবৎ দিনে দুই বার করে শসা অথবা তরমুজ খেলে এবং একবার এর জুস খেলে আপনি অনিয়মিত মাসিক থেকে মুক্তি পাবেন ইনশা’আল্লাহ।
জিরা:
মাসিক নিয়মিত করতে জিরা ভারি উপকারি। এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এক গ্লাস পানিতে ২ চা চামচ জিরা নিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে এই পানি এবং জিরা দুটোই খেয়ে ফেলুন। নিয়মিত সেবন করুন, ইনশা’আল্লাহ সুফল পাবেন।
সবজির জুস:
খাদ্য তালিকায় বেশি বেশি সবজির জুস রাখুন। এটি শরীর ঠাণ্ডা রাখে ও হরমোন রেগুলেশনে সাহায্য করে। গাজর, পুদিনা পাতা, করলার রস ইত্যাদি দিনে দু’বার করে খেতে পারেন। গাজরে প্রচুর বিটা ক্যরোটিন রয়েছে, যা মাসিক নিয়মিত করতে সাহায্য করে। মাসিকের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে দিনে ধনিয়া পাতার রসও সেবন করতে পারেন।
মাসিকের সময় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও আয়রনের চাহিদা তৈরি হয়। এজন্য বেশি বেশি কলা, আপেল, পেয়ারা খাওয়ার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি গরু, মুরগীর মাংস, কলিজা, চিংড়ি, ডিম, কচুর শাক, লাল শাক, পালং শাক, মিষ্টি আলু, ফুলকপি, মটরশুঁটি, খেজুর, গাব, টমেটো, ডাল, ভুট্টা, শস্যদানা ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খান। তবে সফট ড্রিঙ্কস্, কফি ও চা খাওয়া যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।
মূলত সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সামগ্রিক সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য। হরমোনের স্বাভাবিক কার্যকারিতার জন্য আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং প্রোবোটিক্স থাকা অপরিহার্য। সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন এবং নিজেকে ঠান্ডা রাখুন।
তিল এবং গুড়:
তিল আপনার অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দূর করবে। তিলের পুষ্টিগুণ হরমোন উৎপাদনেও সহায়ক। অল্প পরিমাণ তিল ভেজে গুঁড়ো করে নিন। এর সাথে এক চামচ গুড় মিশিয়ে নিন। এটি প্রতিদিন খালি পেটে এক চা চামচ করে খান। প্রতিদিন গুড় খেলেও আপনার মাসিক নিয়মিত হবে।
টক জাতীয় ফল:
টক জাতীয় ফল বিশেষ করে তেঁতুল মাসিক নিয়মিত করতে সাহায্য করে থাকে। চিনি মেশানো পানিতে কিছু তেঁতুল এক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। এরপর এর সাথে লবণ, চিনি এবং জিরা গুঁড়ো মিশিয়ে নিন। এটি দিনে দু’বার করে খেলে দারুণ ফল পাবেন।
যোগ ব্যায়াম এবং মেডিটেশন:
মাসিক নিয়মিত না হওয়ার প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। শরীরে যে সমস্ত হরমোন পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণ করে, স্ট্রেস-এর কারণে সেগুলোর ব্যাল্যান্স নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ঠিকমত পিরিয়ড হয় না। যোগ ব্যায়াম এবং মেডিটেশন স্ট্রেস দূর করতে সাহায্য করে।
মেনেপজ কাকে বলে?
মেনোপজ (রজনীবৃত্তিকাল) হলো জীবনের এমন এক পর্যায় যখন মাসিকচক্র চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, এবং গর্ভধারণের আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। প্রত্যেক মহিলার তলপেটে জরায়ুর দু’ধারে দুটি ডিম্বাশয় থাকে। এদের কাজ হল ডিম্বস্ফূটন এবং হরমোন নিঃসরণ। নারীর বয়স ৪০ পার হওয়ার পর ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এবং বয়স যখন ৫০-এ পৌঁছে যায়, তখন ডিম্বাশয় একদমই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
মেনোপজের পূর্ব লক্ষণ
সাধারণত ছয় মাস একটানা রক্তস্রাব বন্ধ থাকলে ধরে নেয়া যায় যে মেনোপজ পর্যায় শুরু হয়েছে। এসময় হঠাৎ করে গরম লাগা, মনোসংযোগ না থাকা, মাথাব্যথা, দুশ্চিন্তা, যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া, এবং ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। পাশাপাশি কিছু দৈহিক পরিবর্তনও প্রকাশ পায়, যেমন- শরীরে কিছু বাড়তি মেদ জমে থাকা, স্তনের আকার ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে যাওয়া, হজমে ব্যাঘাত, চুল পড়া ইত্যাদি।
নারীদের মেনোপজ হলে দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ কমে যায়। এতে করে হাড়ের ক্ষয়, হাড় ভাঙা, হৃদরোগ, এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক নারীই এসময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কারণ, তাদের বদ্ধমূল ধারণা জীবনের সব কিছুই শেষ হয়ে গেল, এভাবে বাঁচার কোন অর্থ নেই। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মেনোপজ মানে জীবনের এক অধ্যায় থেকে অন্য অধ্যায়ে পদার্পণ। এ নতুন অধ্যায়টি অবাঞ্ছিত নয়- একান্তভাবে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। সংসারে এমন একজন মহিলার মতামতের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর স্বামীর কাছেও তার দাম অনেক বেড়ে যায়, কারণ এখন সে যেকোনো বিজ্ঞচিত মতামত দিতে সক্ষম।
পিরিয়ডের সমস্যাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিন। এসময় গান শোনা, বই পড়া, বাগান করা ইত্যাদি চিত্তবিনোদনমূলক কাজে প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় ব্যয় করুন। এতে পিরিয়ডকালীন ব্যথা আর অস্বস্তি অনেকটাই লাঘব হবে। আর দেখবেন, আপনি খুব স্বাচ্ছন্দ্যে প্রাত্যহিক কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারছেন।
জরায়ু বা যোনি, যা গর্ভাশয় নামেও পরিচিত, মহিলা প্রজনন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি গর্ভধারণ প্রক্রিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় একটি অঙ্গ। বিশেষকরে এটি গর্ভের বিকাশে সহায়তা করে। জরায়ুতে ইনফেকশন, যা জরায়ুগহ্বরের প্রদাহ নামেও পরিচিত, বিভিন্ন কারণে হতে পারে এবং মহিলাদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত নারীদের জরায়ু প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে থাকে। মূলত ভেজা ও সিন্থেটিক পোশাক অনেকক্ষণ পরে থাকার কারণে শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে এসব সংক্রমণ ঘটে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, স্ত্রী যৌনাঙ্গের সঠিক পরিচর্যা না করলে, সেখানে প্রদাহজনিত ব্যথা, যোনি থেকে রক্তপাত ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব ভাইরাস জরায়ুতে দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে, সংক্রমিত কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে তা ক্যান্সারে রূপ নেয়। তাই, মহিলাদের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
জরায়ুর রোগসমূহঃ
মহিলাদের, জরায়ুর মুখ যেখানে যোনির সাথে মিলিত হয়, তাকে সার্ভিক্স বলা হয়। যখন সার্ভিক্স উদ্দীপ্ত হয়, তখন তাকে সারভিসাইটিস বলে। সারভিসাইটিস সংক্রামক বা অসংক্রামক হতে পারে। সাধারণত যৌনবাহিত সংক্রমণের কারণে সারভিক্স উদ্দীপ্ত হয়।
এই যৌনবাহিত রোগগুলি হল-
ক্লামিডিয়া
গনোরিয়া
হার্পিস
লেটেক্স অ্যালার্জি এবং ডিউসিং এর কারণেও জ্বালাভাব (প্রদাহ) সৃষ্টি হয়। যেসব মহিলা ক্যানসারের জন্য রেডিয়েশন থেরাপি নিচ্ছেন তাদেরও সার্ভিক্সের মধ্যে জ্বালাভাব দেখা দিতে পারে। এতে যদি মূত্রনালী সংক্রমিত হয় তবে আক্রান্ত মহিলাটি মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা অনুভব করতে পারেন। যোনিতে চুলকানি অথবা যোনি থেকে রক্তপাতও হতে পারে। বিশেষত যৌন সংসর্গের পরে অথবা মাসিক চক্রের মধ্যখানে অনেক সময় পেটের যন্ত্রণা দেখা দিতে পারে।
এইচপিভি-ও জরায়ু রোগসমূহের মধ্যে অন্যতম। এর ফলে দেহে আঁচিল, গুটি বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়- যা যৌনাঙ্গ থেকে শুরু করে মুখে, হাতে-পায়ে এমনকি মুখের ভেতরেও হতে পারে। এ ভাইরাস খুবই ছোঁয়াচে। সাধারণত নারী পুরুষ যখন প্রথম যৌন-সক্রিয় হয়ে ওঠে তখনই এ সংক্রমণের শিকার হয়।
জরায়ুতে জ্বালাপোড়া
ইনফেকশান হলে জরায়ু জ্বালাপোড়া করতে পারে। গর্ভাবস্থায় জরায়ুর ওজন বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্লাডারে চাপ পড়ে। এতে প্রস্রাব ঠিক মতো বেরোতে পারে না। এক্ষেত্রে সাবধান না হলে কিডনির উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি সময়ের আগেই প্রসূতি বেদনা শুরু হয়। অস্বাভাবিক কম ওজনের শিশু জন্মানোরও ঝুঁকি থাকে। প্রেগন্যান্সির সময় কেটে গেলেও ইউরিনারি ট্রাক্ট (urinary tract) বা ব্লাডার ইনফেকশনের (bladder infection) ঝুঁকি থেকে যায়। প্রস্রাবের সময় জ্বালা করে, তলপেটে চাপ এবং বারবার প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।
চলুন দেখে নিই আর কি কি কারণে জরায়ুমুখে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি হতে পারে –
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানিপান না করার ফলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে। মূলত পানি আমাদের দেহের বেশীর ভাগ রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে। এজন্য প্রতিদিন আমাদের পরিমিত পরিমাণে পানি পান করা উচিৎ।
নারীদের ক্ষেত্রে এই উপর্সগটি বেশ কষ্টদায়ক। মেয়েদের পায়ুপথের খুব কাছেই মূত্রনালী অবস্থিত। যার ফলে পায়ুপথের মাধ্যমে অনেক ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস মূত্রনালীতে প্রবেশ করে এবং জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে।
মাসিক বা পিরিয়ডের কারণেও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে। অনেকে সে সময় অস্বাস্থ্যকর ন্যাপকিন কিংবা কাপড় ব্যবহার করে। এসব ন্যাপকিন বা কাপড়ের সাথেও জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালিতে প্রবেশ করে সংক্রমণের সৃষ্টি করতে পারে।
জরায়ু ব্যথার কারণঃ
মহিলাদের অনেকে তলপেটে ব্যথা এবং নিতম্বের ব্যথায় ভোগেন। বিশেষ করে মাসিক হওয়ার আগে তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। মাসিক হওয়ার সময় এ ব্যথা খুব বেড়ে যায়। পিরিয়ড জনিত দীর্ঘমেয়াদি এ ব্যথা মূলত জরায়ু প্রাচীরের চারদিকে প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে।
গর্ভাবস্থায়ও যোনিতে ব্যথার সৃষ্টি হয়। এর কয়েকটি কারণ-
জরায়ুর বৃদ্ধি: গর্ভাবস্থায় যোনিতে ব্যথার এটি সাধারণ কারণ। জরায়ু ভ্রূণের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গিয়ে আকারে বেড়ে যায়। ফলে এটি যোনি ও আশেপাশের পেশীগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে।
হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থা নারীদেহে হরমোনের পরিবর্তন ঘটায়। এটি যোনিকে অযাচিতভাবে শুষ্ক করে তোলে। এর ফলে যোনিতে ব্যথা সৃষ্টি হয়; বিশেষত যৌন মিলনের সময়।
ভ্রূণের বৃদ্ধি: জরায়ুতে ভ্রূণের আকার বাড়ার সাথে সাথে নিতম্বের লিগামেন্টগুলিও প্রসারিত হয়। যোনিকে ঘিরে থাকা লিগামেন্ট এবং পেশীর অত্যধিক প্রসারণের ফলে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা দেখা দেয়। শিশুর ওজন পেলভিক মেঝেতে চাপ তৈরি করার ফলেও যোনিতে ব্যথা সৃষ্টি হয়।
সংক্রমণ: সংক্রমণের কারণে বাহ্যিক যৌনাঙ্গে এবং যোনিতে ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। এসব লক্ষণ প্রকাশ পেলে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। গর্ভাধারণকালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বিধায়, এসময় মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জরায়ুর বিভাজন: জরায়ুর প্রসারণের ফলে যোনিতে তীক্ষ্ণ এবং শ্যুটিংয়ের ন্যায় ব্যথা হতে পারে। তবে, ব্যথা যদি তলপেটে হয় এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে তবে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিৎ।
পেলভিক অরগান প্রোল্যাপস (পিওপি): পিওপি হল গর্ভাবস্থাকালীন এমন একটি অবস্থা যেখানে শ্রোণী বা তার আশেপাশের অঙ্গগুলি কখনও কখনও যোনি বা মলদ্বারে প্রবেশ করে। আপনি যদি তীব্র চাপ অনুভব করেন, অন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধা হয়, তবে অবিলম্বে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। পিওপি চিকিৎসাযোগ্য, তবে এটি মারাত্মক ব্যথা ও জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।
এক্ষেত্রে করণীয়:
ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমান। এতে আপনার রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে এবং যোনি চাপমুক্ত থাকবে
একইভাবে, আপনার পা উঁচু জায়গায় রেখে বসুন। গর্ভাবস্থায় যোনিপথের চাপ অনেকাংশে হ্রাস করতে এটি সহায়ক। ফলে যোনিতে ব্যথাও কমে যায়।
সাঁতার এবং যোগ ব্যায়ামের মতো সাধারণ অনুশীলনগুলি শরীরে রক্ত চলাচল বাড়াতে এবং পেশী শক্তিশালী করতে অনেক কার্যকর। এভাবে যোনির ব্যথা অনেকখানি উপশম করা সম্ভব।
নিয়মিত কেগেল এক্সারসাইজ করলে যোনির চাপ ও ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
যদি আপনার পেট বিশাল হয়, তবে বুঝে নিবেন এটি শিশুর মাথা যোনিতে চাপ দেয়ার ফলে হচ্ছে। গর্ভাবস্থায় সাপোর্ট বেল্ট পরলে সেই চাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় যোনিতে ব্যথা অস্বস্তিকর হতে পারে যদিও এটি মহিলাদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা। জীবনযাত্রার কয়েকটি পরিবর্তন যোনির ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। তবে আপনি যদি মনে করেন, ব্যথা স্বাভাবিকের চেয়েও খারাপ, তবে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
জরায়ু মুখের ইনফেকশন কি?
জরায়ু ইনফেকশন বা পিআইডি (পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ) বলতে ডিম্বনালীতে জীবাণুর সংক্রমণকে বোঝায়। এটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাক সহ বিভিন্ন জীবাণুর কারণে হতে পারে। মাঝে মাঝে এটি ডিম্বাশয়কেও আক্রান্ত করতে পারে। যৌনবাহিত রোগের (এর মধ্যে chlamydia and gonorrhoea অন্যতম) কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব সংক্রমণ হয়ে থাকে। আবার ডি অ্যান্ড সি, কপার টি, অ্যান্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসি, হিস্টারোসাল-ফিঙ্গোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষার কারণেও জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। এর ফলে প্রজনন অঙ্গগুলোর জটিলতা, গর্ভধারণ সংক্রান্ত সমস্যা এবং অন্যান্য সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়।
জরায়ুতে ইনফেকশন কেন হয়?
জরায়ুতে ইনফেকশনের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে।
যৌন সংক্রামিত রোগ (STD): ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়া এবং ট্রাইকোমোনিয়াসিস জরায়ুতে ইনফেকশনের সাধারণ কারণ।
যোনি ব্যাকটেরিয়োসিস (BV): এটি যোনিতে থাকা “ভালো” ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হলে ঘটে।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার: দীর্ঘ সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে যোনিতে “ভালো” ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
গর্ভপাত: গর্ভপাতের পর জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আইইউডি ব্যবহার: ইন্ট্রা-ইউটেরাইন ডিভাইস (IUD) ব্যবহার জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি সামান্য বৃদ্ধি করতে পারে
অবিবাহিত মেয়েদের জরায়ু ইনফেকশন কেন হয়?
অবিবাহিত মেয়েদের জরায়ু ইনফেকশনের কিছু সম্ভাব্য কারণ:
অস্বাস্থ্যকর যৌন অভ্যাস: যৌনতা চলাকালীন সুরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার না করা, যেমন কনডম, জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার: অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার করলে জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
জরায়ু ইনফেকশনের লক্ষণঃ
অন্যান্য কারণের পাশাপাশি জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনের জন্যও জরায়ু ইনফেকশন হতে পারে। এর ফলে তলপেটে এবং কোমরের নিচে ব্যথা হয় এবং সে ব্যথা লাগাতার চলতে থাকে। এ রোগের কিছু পরিচিত লক্ষণ হলো: এবনরমাল স্রাব, জ্বর, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি।
আরো কিছু লক্ষণঃ
অনিয়মিত মাসিক এবং জ্বর জ্বর লাগা
মাসিকের সময় তীব্র যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা
সহবাসে ব্যথা অনুভূত হওয়া
মল-মূত্র ত্যাগ কালে যৌনাঙ্গ দিয়ে রক্ত বের হয় ও ব্যথা হয়।
হাত, পা, শরীর আগুনে পোড়ার মত জ্বালা করে
প্রস্রাবের সময় ও পরে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক বেদনা
জরায়ুর গ্রীক ফোলা ও শক্ত থাকা
কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অত্যন্ত ক্লান্তিকর অনুভূতি
এই লক্ষণগুলোর তীব্রতা কম বা বেশি হতে পারে। এমনকি অনেক সময় কোনো ধরনের লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও আপনি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কারণ এ রোগের জীবাণুগুলো জরায়ুর মুখে সুপ্ত অবস্থায়ও থাকতে পারে।
গর্ভাবস্থায় জরায়ু ইনফেকশনের লক্ষণ:
যোনি থেকে অস্বাভাবিক স্রাব
যোনিতে চুলকানি ও জ্বালাপোড়া
পেটে ব্যথা
মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা
যোনি থেকে রক্তপাত
কিভাবে সংক্রমণ ঘটে?
জরায়ু সাধারণত ক্ল্যামাইডিয়া, ই. কলাই, স্ট্যাফাইলোকক্কাস, ব্যাকটেরয়েডস, গনোরিয়া ইত্যাদি জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে থাকে। জীবাণুগুলো যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে পুরুষের শুক্রাণু ও ট্রাইকোমোনাড (যা পুরুষের যৌনাঙ্গে থাকে) বাহিত হয়ে যৌনাঙ্গে প্রবেশ করে। পরে জরায়ু, নালী হয়ে ডিম্বাশয়েও এসব ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
নারীদের যৌনাঙ্গে অবস্থিত সার্ভিক্স(cervix) ব্যাকটেরিয়াকে ইউরেটাসে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। সন্তান জন্মদান কিংবা সার্জারির সময় কার্ভিক্স খোলা থাকে বিধায়, এসময়ও ব্যাকটেরিয়া সহজে জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে।
ডায়াগনোসিসঃ
এ রোগ নির্ণয়ের জন্য ল্যাব টেস্টের প্রয়োজন পড়ে। জরায়ুর মুখ বা মূত্রনালী থেকে ডিসচার্জ নিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে জীবাণুর উপস্থিতি নিরূপণ করা হয়। এছাড়া সংক্রমণের লক্ষণ বোঝার জন্য রক্ত, ইউরিন পরীক্ষা ও অ্যাবডমিনাল আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ল্যাপারস্কপি পরীক্ষার মাধ্যমেও জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
প্রতিবছর দেশে প্রায় ৯ হাজার নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বাস করা মহিলাদের জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। গ্রামীণ নারীরা তাদের নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নন। প্রথমে জরায়ু-তে ইনফেকশন, এবং পরে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে ক্যান্সারে রূপ নেয়। অনেকে লজ্জার কারণে চিকিৎসাও নিতে চায় না। তারা শরীরে রোগ পুষে রাখে। অনেক সময় মারাত্মক ইনফেকশনের ফলে রোগীকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অপরিণত বয়সে বিয়ে এবং ঘন ঘন প্রেগন্যান্সি বা ডেলিভারির কারণে জরায়ু ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। যেসব মেয়েরা বহুগামী কিংবা স্বামীরা অনেকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে এমন ক্ষেত্রেও নারীদের এইচপি (Human Papilloma Virus) ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
জরায়ু ইনফেকশনের ঔষধঃ
প্রাথমিক অবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক এবং পেইন কিলার দিয়ে জরায়ু ইনফেকশনের চিকিৎসা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ওষুধগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় খেতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিক: ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের জন্য
অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ: ছত্রাকের সংক্রমণের জন্য
ভাইরাসবিরোধী ওষুধ: ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য
জরায়ু সংক্রমণের প্রতিকারে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকস্:
Pulmocef 1500
Zomycin 250
Zybact 250 Mg
Cefadur CA 250 Mg
Zycin 250 mg
ALTAXIME 500MG
Cef 250 ইত্যাদি।
যদি এসব অ্যান্টিবায়োটিকস্ সেবনের পরও কোনো উন্নতি দেখা না যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে আপনি অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সার্জারি করার দরকার হতে পারে; যেমন: ডিম্বনালী সংক্রমিত হয়ে পুঁজের সৃষ্টি হলে এবং বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায়। এছাড়া যাদের বয়স বেশি তাদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের তীব্রতা কমানোর জন্য ডিম্বনালী এবং জরায়ু সার্জারি করে অপসারণ করা হয়।
উল্লেখ্য, আপনার যদি ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস ধরা পড়ে সে ক্ষেত্রে আপনাকে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হবে যা গর্ভকালীন সময়েও নিরাপদ। তবে অবশ্যই অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করতে হবে যদিও সংক্রমণের লক্ষণগুলো সেরে যায়। অন্যথায়,আবার যেকোন মুহূর্তে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। ৩০ ভাগ মহিলার ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস তিন মাসের মধ্যে আবার দেখা দেয়। অ্যান্টিবায়োটিক এর কাজ হল খারাপ ব্যাকটেরিয়াগুলো-কে মেরে ফেলা। কিন্তু এটি ভালো ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। পুনরায় লক্ষণ প্রকাশ পেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন। এর পাশাপাশি স্বামী বা পার্টনারের চিকিৎসাও জরুরি। অন্যথায় বার বার জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাবে।
সময়মতো চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তাঃ
যথাসময়ে জরায়ু ইনফেকশনের চিকিৎসা না করালে বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে দীর্ঘদিন ধরে তলপেট ব্যথা, কোমর ব্যথা, ডিম্বনালীর পথ বন্ধ হয়ে বা জরায়ু এবং এর আশপাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক অবস্থান নষ্ট হয়ে সন্তান ধারণে অক্ষমতা বা বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি ডিম্বনালীর পথ বাধাগ্রস্ত হয়ে একটোপিক প্রেগনেন্সিও (জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ) হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। প্রজননতন্ত্র সংক্রমণের যথাযথ চিকিৎসা না নিলে গর্ভপাত, সময়ের আগে বাচ্চা প্রসব এবং কম ওজনের বাচ্চা জন্মদানেরও ঝুঁকি বেড়ে যায়। আর গর্ভবতী নয় এমন মেয়েদের ক্ষেত্রে পেলভিক ইনফ্লেমেটরি ডিজিজ এর আশঙ্কা দেখা দেয়। এটি sexually transmitted disease (যেমন- গনোরিয়া, ক্লামাইডিয়া, HIV ইত্যাদি)-এ সংক্রমিত হওয়ার পথকে সুগম করে।
তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য সমস্যা। শুধু একটু সচেতনতা আপনাকে মারাত্মক জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে।
জরায়ু ইনফেকশনের হলে ঘরোয়া চিকিৎসা
এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান খুব উন্নত। তবে ডাক্তারি পরামর্শের পাশাপাশি আপনি ঘরোয়া কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
চলুন, দেখে নিই কি উপায়ে আপনি ঘরে বসেই সংক্রমণের মাত্রা হ্রাস করবেন-
দই ব্যবহারে:
দইয়ে Lactobacillus acidophilus নামে একধরনের ভাল ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। যেখানে খুব চুলকানি হচ্ছে বা সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে, ২০-৩০ মিনিট দই লাগিয়ে রাখুন। তারপর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। সরাসরি যৌনাঙ্গেও দই লাগাতে পারেন। দিনে দু’বার লাগান। ঘণ্টা দুই রেখে ধুয়ে নিন। এটি আপনার শরীরকে যেকোনো ধরনের ইনফেকশন থেকে রক্ষা করবে।
নারকেল তেল:
নারকেল তেলে অ্যান্টিফানগাল উপকরণ থাকে যা ছত্রাককে ধরাশায়ী করতে খুবই কার্যকরী। সংক্রমণ এলাকায় (তবে যৌনাঙ্গের ভিতরে লাগাবেন না) ভালভাবে নারকেল তেল লাগান। দিনে ২ থেকে ৩ বার লাগালে দ্রুত কাজ হবে। সঙ্গে একটু দারুচিনি তেল মিশিয়ে নিলে সংক্রমণ ছড়ানোর আর ভয় থাকবে না।
অ্যাপল সিডার ভিনিগার:
হাল্কা গরম জলের সঙ্গে দুই টেবিল চামচ অ্যাপল সিডার ভিনিগার মিশিয়ে দিনে দু’বার করে সপ্তাহখানেক খান। সাদা ভিনিগার বা অ্যাপল সিডার ভিনিগার জলে মিশিয়ে সংক্রমণের জায়গায়ও লাগাতে পারেন। এতে ভালো কাজ হবে।
রসুন:
অ্যান্টিফাংগাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং ঘরোয়া অ্যান্টিবায়োটিক হিসাবে রসুনের জুড়ি নেই। কয়েক কোয়া রসুন নিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। যেসব জায়গায় ফুসকুড়ি হয়েছে বা জ্বলছে ঐ স্থানে কিছুক্ষণ লাগিয়ে রাখুন। পাশাপাশি রোজ এক কোয়া করে রসুন খেতে পারেন। ছত্রাক নিরাময়ে এটি বেশ উপকারি।
যতটা সম্ভব ঢিলেঢালা পোশাক পড়া দরকার। আর সংক্রমণের জায়গাটা সবসময় পরিষ্কার রাখবেন। প্রচুর পরিমাণে পানি খাবেন। দেখবেন দ্রুত সেরে উঠছেন ইনশা’আল্লাহ।
যেসব বিষয় মেনে চলা খুব জরুরি:
নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক এবং কনডম ব্যবহার জীবাণুর সংক্রমণ থেকে জরায়ুকে রক্ষা করে।
যত্রতত্র এম আর (গর্ভপাত) করানো থেকে বিরত থাকুন। বাংলাদেশে অনেক ফার্মেসির দোকানেও গর্ভপাত করানো হয়। যা কখনোই উচিৎ নয়। কারণ সেখানে জীবাণু সংক্রমণের পাশাপাশি মৃত্যু ঝুঁকিও থাকে। তাই গর্ভপাত বা ডিএন্ডসি করাতে হলে কোন ভালো গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গিয়ে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে গর্ভপাত করানো উচিৎ।
ধূমপানের অভ্যাস থাকলে এখনি তা ত্যাগ করার সময়। ধূমপায়ীদের রক্তে (নিকোটিনের) পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে সংক্রমণের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং জরায়ুর মুখে ক্যান্সার এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
হট টাব বা বাথ টাব এ গোসল না করে শাওয়ার নেয়ার চেষ্টা করুন। গোসলের পর যৌনাঙ্গ ভালোভাবে পরিষ্কার এবং শুষ্ক রাখতে হবে। সুগন্ধি ও রুক্ষ সাবান যথাসম্ভব পরিহার করুন।
বিশেষ অঙ্গের নিয়মিত যত্ন ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আপনাকে পরিছন্ন ও স্বাস্থ্যবান রাখবে। যত্ন নেয়া মানে শুধু গোসলের সময় পরিষ্কার করা নয়। নারীদের যৌনাঙ্গ প্রতিদিন তিন থেকে চারবার পরিষ্কার করা উচিৎ। বিশেষ করে বর্ষা ঋতু এবং পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে। এতে করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
সুতি কাপড় নরম এবং অধিক ত্বকবান্ধব। এটি দ্রুত আর্দ্রতা শুষে নেয় এবং বাতাস চলাচলের জন্য অধিক উপযোগী। বিশেষ কোনো উপলক্ষে সুতি কাপড়ের অন্তর্বাস পরতে পারেন। পাশাপাশি টাইট জামাকাপড় এড়িয়ে চলুন। কারণ এ ধরনের পোশাক বায়ু চলাচলে বাধা তৈরি করে।
Douche ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। গর্ভাবস্থায়ও Douche এর ব্যবহার উচিৎ নয়।
কোনো রকম ছোট সংক্রমণকে অবহেলা করা উচিৎ নয়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, যৌন-স্বাস্থ্য ভালো থাকা মানে শরীর ভালো থাকা। নির্বিঘ্ন সুরক্ষিত যৌনজীবন আনন্দময়।
বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য পেয়েছে কোভিড-১৯, যা করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত । এই ভাইরাসের বিস্তার জনজীবনকে অস্বাভাবিক করে তুলেছ। মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারছে না। শ্রমজীবী-পেশাজীবী মানুষকে ঘরবন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে। এই রোগটির সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে বিশ্ব মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে।
পুরনো হলেও, এই মরণঘাতী ভাইরাসের সাথে কয়েকদিন আগেও মানুষের পরিচয় ছিলো না। ২০০২ সালে চীনে সংক্রমিত হওয়া সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) ভাইরাসে মারা গিয়েছিল ৭৭৪ জন। সংক্রমিত হয়েছিল আরো হাজার হাজার মানুষ। এটিও ছিল এক প্রকারের করোনাভাইরাস।
করোনা ভাইরাস কি?
এটি মূলত ভাইরাসের একটি শ্রেণি, যা স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। হোমো স্যাপিয়েন্সের মাঝে এদের সংক্রমণস্থল শ্বাসনালীর অভ্যন্তরে। অনেক সময় এই সংক্রমণের লক্ষণ মৃদু হতে পারে, যা সাধারণ সর্দি-কাশির মতোই। আবার অনেকক্ষেত্রে জ্বর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যাও দেখা যায়।অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে এই লক্ষণের তারতম্য দেখা যায়। যেমন, মুরগির মধ্যে এটি উর্ধ্ব শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ঘটায়, গরু ও শূকরে এটি ডায়রিয়া সৃষ্টি করে।
মানবদেহে সৃষ্ট করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানোর মত কোনো টিকা বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আজও আবিষ্কৃত হয়নি।
কিভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল এই ভাইরাস?
মাঝে মাঝে জীব-জন্তু থেকে নতুন কোনো ভাইরাস মানুষের শরীরে বাসা বাধে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, করোনার উৎস কোনো প্রাণী। এই ভাইরাসে মানুষের প্রথম আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের উহান শহরে একটি মাছের আড়ৎ-এ। শহরের ঐ বাজারটিতে অনেক জীবন্ত প্রাণীও পাওয়া যেত, যেমন মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, সাপ ইত্যাদি । এসব প্রাণী এই করোনাভাইরাসের উৎস হতে পারে বলে মনে করা হয়।
পরীক্ষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের বাদুড়ের মাঝে সংক্রমণ ঘটায় এমন ভাইরাসের সাথে এর ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে। তাদের ধারণা, ভাইরাসটি প্রথমে বাদুড় থেকে অন্য কোনো প্রাণীতে প্রবেশ করেছে। এবং এরপর কোনোভাবে সেটা মানুষের শরীরে পৌঁছে গেছে।
করোনা ভাইরাসের লক্ষণঃ
এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন:
অবসাদ
মাথা ব্যাথা
গলা ব্যাথা
অঙ্গ বিকল হওয়া
পেটের ব্যাথা
শ্বাসকষ্ট
শুষ্ক কাশি
বমি হওয়া
জ্বর
এটি মানুষের শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ঘটায় এবং আক্রান্ত ব্যাক্তির সংস্পর্শে যাওয়া কারণে একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডার মতো এই ভাইরাস হাঁচি কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। আক্রান্ত হলে অনেকসময় শুষ্ক কাশির সঙ্গে জ্বরও থাকে।
জ্বর ও কাশি’র মোটামুটি ৭ দিনের মাথায় শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। ডব্লিউএইচও-এর মতে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সবগুলো লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৪ দিন পর্যন্তও সময় লাগতে পারে। এটাকে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড।
রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা ( ডায়াবেটিস, অ্যাজমা,উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ইত্যাদি) রয়েছে তারা মারাত্মকভাবে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঘ্রাণ না পাওয়াও করোনায় সংক্রমণের লক্ষণ
ব্রিটিশ গবেষকরা বলছেন, স্বাদ হারানো বা ঘ্রাণ না পাওয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে এই গবেষণাটি চালিয়েছে কিংস কলেজ লন্ডন। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন এমন চার লাখের বেশি মানুষ এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন।
তবে ফুসফুসের অন্যান্য জটিলতার ক্ষেত্রেও স্বাদহীনতা বা ঘ্রাণ না পাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশিত হয়। এসব লক্ষণ প্রকাশিত হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।
এই ভাইরাসের লক্ষণ কি পরিবর্তনশীল হতে পারে?
হ্যাঁ, আক্রান্ত ব্যক্তি যখন চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকেন, তখন হঠাৎ করে তার এই লক্ষণগুলো আর প্রকাশ পায় না। তিনি সুস্থ বোধ করেন। কিন্তু আবারও এই লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে রোগীর শরীরে। কয়েকদিন বা সপ্তাহধরে জ্বর, ক্লান্তি এবং শ্বাসকষ্টের মাত্রা পরিবর্তন হতে থাকে।
আপনার কি লক্ষণ ছাড়াই কোভিড -১৯ থাকতে পারে?
কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণসমূহ সাধারণত ২-১৪ দিনের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তবে অনেক সংক্রমিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় না এবং তারা অসুস্থও বোধ করে না।
আক্রান্ত ব্যক্তির হাতে তৈরি খাবার থেকে ভাইরাসের সংক্রমণ
ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যদি স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রান্না না করেন তবে সেই খাবার থেকে আপনার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। আমাদের কাশির সঙ্গে যে সূক্ষ্ম থুতুকণাগুলো বেরিয়ে আসে এগুলোকে বলা হয় ‘ড্রপলেট’। হাঁচি বা কাশির সঙ্গে এই ভাইরাস খাবার বা আমাদের ব্যবহার্য জিনিসে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করা জরুরি। আর যারা খাবার তৈরি করছেন, যে কোন খাদ্যবস্তু স্পর্শ করার আগে তার উচিৎ ভালভাবে হাত ধুয়ে নেয়া।
শিশুরা কি ঝুঁকিতে?
যে কোন বয়সের মানুষই করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে বিশেষ করে অসুস্থ বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস মারাত্মক হতে পারে। আবার বস্তিতে থাকা দরিদ্র শিশুদের ক্ষেত্রেও এই ভাইরাসের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। কারণ তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার কারণে সহজেই ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোরের মতে, “এই করোনাভাইরাসটি ভয়াবহ গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। শিশুদের উপর এই ভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কে আমরা আশঙ্কাগ্রস্ত । কিন্তু নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধ এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। সময় আমাদের সাথে নেই।”
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়ীত্বকাল
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই ভাইরাসকে কতদিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে পারবে- এই নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। তবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে আমাদের অবশ্যই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে হবে। আর যেহেতু রোগটি নতুন,তাই এই নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী তথ্যের অভাব রয়েছে। এজন্য আশ-পাশের মানুষের সুরক্ষার জন্য অন্যদের মাঝে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেয়া আক্রান্ত ব্যক্তির নৈতিক দায়িত্ব।
লক্ষণ প্রকাশ পেলে কি করবেন?
নিজের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপরোক্ত লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে প্রথমে নিজেকে সবার থেকে আলাদা রাখতে হবে। এর পর নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর বা সরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিকে যোগাযোগ করতে হবে। তাঁদের দেয়া পরামর্শ মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে নিচের হটলাইন নম্বরগুলোতে যোগাযোগ করা যেতে পারে: ৩৩৩ ১৬২৬৩ ১৬৬৩৩ ১০৬৫৫ ০১৯৩৭০০০০১১ ০১৯৩৭১১০০১১ ০১৯২৭৭১১৭৮৪ ০১৯২৭৭১১৭৮৫
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করার উপায়:
সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে নিম্নোক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে বা অ্যালকোহলযু্ক্ত হাত-ধোয়ার সামগ্রী ব্যবহার করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
কাশি বা হাঁচি দেবার সময় মুখ এবং নাক কনুই দিয়ে বা টিস্যু দিয়ে ঢেকে রাখুন। ব্যবহৃত টিস্যুটি তাৎক্ষণিকভাবে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিন।
ঠান্ডা লেগেছে বা জ্বরের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে রোগীদের আলাদা আলাদা করে চিকিৎসা দেয়া।
করমর্দন এবং কোলাকুলির মাধ্যমেও করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। এজন্য করমর্দন এবং কোলাকুলি না করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আসুন জেনে নিই, যে পাঁচটি স্বাস্থ্য উপকরণ আমাদের সবার ঘরে থাকা জরুরি-
১. জীবাণুনাশক হ্যান্ডওয়াশ
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বাসা-বাড়িতে জীবাণুনাশক হ্যান্ডওয়াশ রাখতে হবে । খাবার রান্না করার আগে ও পরে, খাবার খাওয়ার আগে-পরে, প্রতিবার বাথরুম ব্যবহারের আগে ও পরে, এবং বাইরে থেকে বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই জীবাণুনাশক হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
এছাড়াও বিভিন্ন কাজে আমাদের জীবাণুনাশক হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে।
হাত ধোয়ার সঠিক পদ্ধতি:
ধাপ ১: প্রবাহমান পানিতে হাত ভেজানো; ধাপ ২: ভেজা হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সাবান ব্যবহার করা; ধাপ ৩: হাতের পেছনের অংশ, আঙ্গুলের মধ্যের অংশ এবং নখের ভিতরের অংশ অন্ততপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে ধোয়া; ধাপ ৪: প্রবাহমান পানিতে ভালোভাবে কচলে হাত ধোয়া; ধাপ ৫: একটি পরিষ্কার কাপড় বা এককভাবে ব্যবহার করেন এমন তোয়ালে দিয়ে হাত ভালোভাবে মুছে ফেলা।
বার বার হাত ধুয়ে নিবেন। বিশেষ করে, নাক পরিস্কার করার পর, কাশি বা হাঁচি দেওয়ার পরেও। আর যদি সাবান বা পানি বা থাকে, তবে অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।
টয়লেট বা ধুলা-ময়লা পরিষ্কার করা এবং হাড়ি-পাতিল ধোয়ার মতো গৃহস্থালি কাজেও রাবার গ্লাভস ব্যবহার করুন।
৪. বক্সড টিস্যু
বাড়ির প্রতিটি ঘরে টিস্যু রাখুন। যাতে কাশি বা হাঁচির সময় হাত বাড়ালেই টিস্যু পাওয়া যায়।
৫. ভেজা টিস্যু, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং পকেট টিস্যু
স্যানিটাইজার বা ভেজা টিস্যু ঘরে বা ঘরের বাইরেও ব্যবহার করা সম্ভব। যখন হাতের কাছে সাবান বা পানি পাওয়া যাবে না, তখন আপনি সহজেই এসব ব্যবহার করে জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেন। আমাদের সকলেরই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।
আমাদের কি মেডিক্যাল মাস্ক পরা উচিৎ?
যদি কারো শ্বাসকষ্টের লক্ষণ (কাশি বা হাঁচি) থাকে, তবে অন্যের সুরক্ষার জন্য মেডিকেল মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি । তবে আপনার যদি ভাইরাসের কোনো লক্ষণ না থাকে, তাহলে মাস্ক পরার কোনো প্রয়োজন নেই।
আর কেউ যদি একান্তই মাস্ক ব্যবহার করেন, তবে ভাইরাস সংক্রমণের বাড়তি ঝুঁকি এড়াতে অবশ্যই এর যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। এবং ব্যবহার শেষে মাস্ক নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিতে হবে।
তবে শুধু মাস্কের ব্যবহার এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে যথেষ্ট নয়। এর সাথে অবশ্যই ঘন ঘন হাত ধোয়া, হাঁচি ও কাশি ঢেকে রাখা, এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিৎ ।
যদি আপনার সন্তানের কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে কি করা উচিত?
যদি কারো কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দেয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসা সেবা নিতে হবে। এসময় নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে হাত ধোয়া এবং শ্বাসতন্ত্রজনিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি। যদি অন্য কোনো ভাইরাসের সংক্রমণ থাকে তাহলে প্রয়োজন অনুযায়ী সন্তানকে ভ্যাকসিন দিন। এছাড়াও, অন্যদের মধ্যে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য জনসমাগমস্থলে (কর্মক্ষেত্র, বিদ্যালয়, গণপরিবহন) যাওয়া যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। এর পাশাপাশি জীবাণুনাশক ক্লিনার ব্যবহার করে দরজার নক, ফোন, ট্যাবলেট এবং ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র ঘন ঘন পরিষ্কার করুন। এসময় আক্রান্ত ব্যক্তিকে বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দিন। আর এক্ষেত্রে যদি সম্ভব হয় আক্রান্ত ব্যক্তির আলাদা বাথরুম ব্যবহার করা উচিৎ ।
ভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্বের কার্যকারিতা
আমাদের শুনে হয়তো খারাপ লাগছে যে, এতগুলো ক্রীড়া ইভেন্ট, উৎসব এবং অন্যান্য জমায়েত বাতিল করা হচ্ছে। মূলত এর পেছনে জনস্বাস্থ্য রক্ষা অন্যতম উদ্দেশ্য। এভাবে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা একটি অভিনব কৌশল। অফিসে না গিয়ে বাসায় থেকে কাজ করা এবং স্কুল বন্ধ করে বা অনলাইনে ক্লাস স্যুইচ করে সামাজিক দূরত্ব তৈরি অত্যন্ত কার্যকরী।তবে, অনেকের মতে এটা কার্যকরী নয় বরং তথ্য বিভ্রাট।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ভেষজ চা:
আমরা অনেকেই এক কাপ গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সকাল শুরু করি। কিছু লোক কাজের পরে সন্ধ্যায় সতেজ চা পান উপভোগ করেন। আমরা যদি প্রতিদিন চা গ্রহণ করার অভ্যাস গড়ে তুলি, তবে এটি ভাইরাল সংক্রমণের জন্য আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলবে। চলুন কিছু ইমিউন বুস্টার ভেষজ চা সম্পর্কে জেনে নিই।
গ্রিন টি(Green Tea):
আমরা সকাল বেলা গ্রিন টি খেতে পারি। এটি ক্যাফেইনের দুর্দান্ত উৎস; যা আমাদের দেহে ইনস্ট্যান্ট শক্তি সরবরাহ করে থাকে। তাছাড়া, গ্রিন টি-তে বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে, যেমন- পটাসিয়াম (K), আয়রন (Fe), ক্যালসিয়াম (Ca), প্রোটিন, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন এ, যা আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।
এছাড়াও শুকনো গ্রিন টি পাতায় কিছু সক্রিয় পদার্থ রয়েছে, যেমন- ফ্যাটি অ্যাসিড, তেল, ফ্ল্যাভানলস্, ক্লোরোফিল এবং আরও অনেক ভেষজ উপাদান। এসব পদার্থের মাধ্যমে গ্রিন টি আমাদের দেহে বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং অ্যান্টি-এনজাইমেটিক বিক্রিয়া করে । এইভাবে গ্রিন টি অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং অটোইমিউন রোগ প্রতিরোধ করে এবং আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে।
গ্রিন টি কীভাবে প্রস্তুত করবেন:
আধা লিটার পানি প্রায় ১০ মিনিটের মতো সিদ্ধ করুন। সিদ্ধ পানিতে ১টা টি-ব্যাগ বা ১ চামচ চা-পাতা দিন এবং এভাবে আরো ৩-৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। তারপরে চা ব্যাগটি সরিয়ে ফেলুন বা চা ছাড়িয়ে দিন। আরো স্বাদের জন্য আপনি গ্রিন টিতে ১ চামচ লেবুর রস এবং ১চামচ মধু যোগ করতে পারেন। এভাবে আপনি খুব সহজে গ্রিন টি তৈরি করে নিতে পারেন।
লেবু চা:
আপনি যখন গলা ব্যথা, অবিরাম মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, অথবা অন্য কোনো ঠান্ডাজনিত অসুস্থতা অনুভব করেন, এ অবস্থায় আপনি বেছে নিতে পারেন এসবের ঘরোয়া প্রতিকার লেবু চা। এছাড়াও লেবু চা প্রদাহ হ্রাস, রক্তচাপ হ্রাস, রক্তনালীগুলির কার্যকারিতা বাড়ানো, হজমে সাহায্য করা-সহ অসংখ্য সুবিধা দিতে পারে। এমনকি লেবু সাধারণ সর্দি, ফ্লু, H1N1 (সোয়াইন) ফ্লু, সাইনাস প্রদাহ, টিনিটাস, পেট খারাপ, বমি বমি ভাব, কিডনিতে পাথর ইত্যাদির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের এই মহামারীতে চিকিৎসকরা COVID19 এর চিকিৎসার জন্য ভিটামিন সি ডোজ প্রয়োগ করেছেন। কারণ এখনও পর্যন্ত করোনার অনুমোদিত কোনো ভ্যাকসিন নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে, COVID19 এবং অন্যান্য সাধারণ ধরণের ভাইরাল সংক্রমণ রোধে প্রতিদিন ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খাওয়া অত্যন্ত উপকারি। লেবু ভিটামিন সি এর অন্যতম প্রধান উৎস। তাই লেবু চা আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার অংশ হতে পারে।
লেবু চায়ের প্রস্তুত প্রণালী:
প্রথমে আধা লিটার পানি ১০ মিনিটের জন্য সিদ্ধ করুন। সাথে দারুচিনি, গোল মরিচ, লবঙ্গ, কালোজিরা, তেজপাতা, এলাচ পরিমাণমত যোগ করুন। তারপর ১ চা চামচ চা-পাতা যোগ করুন। চা পাতা কয়েক মিনিটের জন্য জ্বাল দিন। চায়ের স্বাভাবিক রং হওয়ার পর ২ চামচ লেবুর রস যোগ করুন। অতিরিক্ত স্বাদের জন্য, আপনি আপনার লেবু-চাতে ১ চামচ মধু যোগ করতে পারেন।
আদা চা:
হাঁপানি, সর্দি, কাশি, বমি বমি ভাব, বাত, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ব্যাধি, ভ্রমণ অসুস্থতা, হতাশা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা নিরাময়ের জন্য আদা মূল বা গুঁড়ো অত্যন্ত কার্যকর সমাধান। আদার ব্যবহার ভাইরাস সংক্রমণকেও প্রতিরোধ করে। আদার ব্যবহার আপনার শরীরের সঞ্চিত টক্সিনগুলোকে ভেঙে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। ফুসফুসের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আদা অত্যন্ত উপকারি।
আদা প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা আপনার দেহ কোষের ডিএনএ কাঠামোর ক্ষতি প্রতিরোধ করে। COVID19 এর বিরুদ্ধে আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও শক্ত করতে, আপনি আপনার ডায়েট পরিকল্পনায় আদা চা যুক্ত করতে পারেন।
আদা চা কীভাবে প্রস্তুত করবেন:
এক চা চামচ আধা গুঁড়া বা টাটকা আদা ১/২ লিটার পানিতে যোগ করুন এবং এগুলো ১০-১৫ মিনিট ধরে সিদ্ধ করতে থাকুন। এরপর ১ চা চামচ চা-পাতা যুক্ত করুন। ২-১ মিনিট পর চা চুলো থেকে নামিয়ে ফেলুন । পানীয়টি স্বাস্থ্যকর করতে আপনি ১ চামচ লেবুর রস এবং ১ চামচ মধু যোগ করতে পারেন।
এছাড়া আমরা প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কালোজিরা ও রসুনের ভর্তা, অথবা সরিষা ভর্তা যোগ করতে পারি। এসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এজেন্টস্ থাকে। পাশাপাশি এসব খাদ্য গ্রহণে আমাদের শরীরের pH লেভেলে ভারসাম্য তৈরি হয়। তাছাড়া এসব মুখরোচক খাবার আমাদের এনার্জির ঘাটতি দূর করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
করোনা ভাইরাসের ঔষধ:
কবে এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হবে? এখন এই প্রশ্ন সবারই। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য দুরন্ত গতিতে গবেষণা চলছে। এই মুহূর্তে ২০টিরও বেশি প্রতিষেধক তৈরির কাজ চলছে। তবে গবেষকরা এ বছরের মধ্যে প্রতিষেধক তৈরি করতে পারলেও এটিকে বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন করার চ্যালেঞ্জ থেকেই যায়। এই পরিস্থিতিতে অনেক দেশ অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখতে হার্ড ইমিউনিটি পলিসির দিকে ঝুঁকছে।
ভ্যাকসিন বা টিকা:
গোটা বিশ্বে গবেষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে করোনা ভাইরাসের টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি ক্ষেত্রে ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ শুরু হয়ে গেছে৷ তবে এগুলোর সফল বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
পাশাপাশি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধিভুক্ত জেনার ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট-এর নেতৃত্বে একটি প্রি-ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট হয়। অক্সফোর্ডের গবেষক দলটির দাবি, তাদের উদ্ভাবিত টিকা একবার নিলেই শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, যা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করবে। পরীক্ষামূলক এই টিকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিএইচএডিওএক্সওয়ান এনসিওভি-১৯’। সফল পরীক্ষা শেষে চলতি বছরেই এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
আবার, প্রাণঘাতী নোভেল করোনা ভাইরাসের (2019-nCoV) টিকা উদ্ভাবনে কাজ করছেন রাশিয়া ও চীনের বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে চীন করোনা ভাইরাসের জেনোম রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তারা আশা করছেন, শিগগিরই ভাইরাসটির প্রতিষেধক উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন দেশে ট্রায়াল দেয়া ঔষধ সমূহ:
যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশে করোনার চিকিৎসায় ‘রেমডেসিভির’ ব্যবহার করা হচ্ছে। সার্স ও ইবোলা ভাইরাসের প্রতিরোধে এটা অনেক কার্যকর ছিল। তাছাড়া ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনে এন্টিভাইরাল থাকায় চিকিৎসকরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এটি সেবনেরও পরামর্শ দিচ্ছেন।
আবার চীনে করোনা রোগীর চিকিৎসায় অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি ইন্টারফেরন আলফা-টুবিও প্রেসক্রাইভ করা হচ্ছে। এ থেকেও আশাপ্রদ ফল পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া যুক্তরাজ্যের ‘রিকভারি ট্রায়ালে’ পরীক্ষা করা হচ্ছে ডেক্সামেথাসন নামের একটি ঔষধের। এটি এক ধরণের স্টরয়েড যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
তাছাড়া ‘জাপানের ফুজিফিল্ম তয়োমা ফার্মাসিউটিক্যালস লি.- তৈরি ফ্যাভিপিরাভির ‘অ্যাভিগান (Avigan)’ অ্যান্টভাইরাল ওষুধ হিসেবে অনেক কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৪ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসায় এটি তৈরি হয়েছিল। চীনের উহানে কভিড-১৯-এ ব্যাপক প্রাণহানির পর ‘অ্যাভিগান’ ভাইরাসের প্রতিরোধে অনেক সুফল দিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ফ্লুর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় ওসেলটামিভির নামে একটি ওষুধ। এবং এইচআইভি-র চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের নাম লোপিনাভির এবং রিটোনাভির। ব্যাংককের রাজাভিথি হাসপাতালের ফুসফুস বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জানিয়েছেন, এসব ওষুধের প্রয়োগে করোনা রোগীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে। তাঁরা এটাকে বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন।
হার্ড ইমিউনিটি কি?
যখন কোনো এলাকার বেশিরভাগ মানুষকে একটি সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক দেয়া হয়, তখন ঐ এলাকায় রোগের সংক্রমণের আশঙ্কা আর থাকে না। কারণ ঐ অবস্থায় সংক্রমিত হওয়ার মতো আর কোনো মানুষই থাকে না।
কিন্তু করোনাভাইরাসের তো এখনো কোনো প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কৃত হয়নি।
হার্ড ইমিউনিটি কিভাবে কাজ করে?
এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে, যারা একবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে এক ধরনের শক্তিশালী ইমিউনিটি তৈরি হয়। এভাবে বেশি মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে থাকলে এক সময় বড় সংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাইরাসের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। যার কারণে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সুরক্ষা বলয় তৈরি হয়, যাতে করে রোগটির সংক্রমণ থেমে যায়।
তাই সংক্রমণের শুরুতে এই হার্ড ইমিউনিটির ভরসাতেই ছিলো সুইডেন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ব্রাজিল, ইতালির মতো দেশ। এজন্য তারা অন্যান্য দেশের মতো লকডাউন সিস্টেমে যায় নি। এর নেপথ্যে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখাও উদ্দেশ্য ছিল। তবে এসব দেশে মৃত্যুহার এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, বাধ্য হয়ে পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য, ইতালি হার্ড ইমিউনিটি ফর্মূলা থেকে সরে এসেছে। কিন্তু সুইডেন তাদের নীতিতে এখনও অটল। তারা তাদের বিপণী বিতান, পরিবহন, মানুষের অবাধ চলাচল চালু রেখেছে। সেই দেশের সরকারের দাবি রাজধানী স্টকহোমে এরই মধ্যে প্রতিটি নাগরিক হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করেছে।
দীর্ঘ দিনের লকডাউনের পর বাংলাদেশ সরকার এখন আস্তে আস্তে হার্ড ইমিউনিটির দিকেই হাঁটছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের দাবি হার্ড ইমিউনিটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেসব মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে তাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার সক্ষমতা সরকারের নেই। এতে ডেথ রেট ক্রমশ বাড়তে পারে। তাই, হার্ড ইমিউনিটি পলিসি প্রয়োগে একটা বড় আশঙ্কা থেকেই যায়।
মহামারির সময়ে সতর্কতা প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, কোথাও মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা থেকে চলে এসো না। অন্যদিকে কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গায় যেয়ো না। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ১০৬৫)
তাই আমাদের উচিৎ, যেখানে এ ধরনের রোগের প্রকোপ দেখা দেবে, সেখানে যাতায়াত থেকে বিরত থাকা। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ সরকারিভাবে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে যাতায়াতে সতর্কতা জারি করেছে; যেহেতু চিকিৎসকদের মতে এ ভাইরাসটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণত ফ্লু বা তীব্র নিউমোনিয়া সিনড্রোমের মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায়।
এছাড়া নবিজি (স.) মহামারি থেকে বাঁচতে বেশি বেশি এই দোয়া পড়তে বলেছেন- اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ (আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুযামি,ওয়া মিন্ সাইয়ি-ইল আসক্কম)। অর্থাৎ, হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত রোগ, পাগলামি, কুষ্ঠ রোগ এবং জানা-অজানা সকল প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে।
সর্বোপরি করোনা প্রতিরোধে আমাদের যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। আর সাথে সাথে মহান রব্বুল আ’লামিনের কাছে এই ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য বেশি বেশি দু’আ করতে হবে। তাহলেই আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে আমরা এই মহমারী থেকে রক্ষা পাবো ইনশা’আল্লাহ।
টাইফয়েড আমাদের অতি পরিচিত একটি রোগ। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময় এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে শীত শেষ হওয়ার পর গরম পড়তে শুরু করলে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে যায়। টাইফয়েড এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ।
মূলত সালমোনালা টাইফিমিউরিয়াম বা এস. টাইফি ও প্যারা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে এই রোগ হয়। মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণী এই রোগ বহন করে না। তাই টাইফয়েড আক্রান্ত ব্যক্তিকে যথাসময়ে চিকিৎসা প্রদান না করলে তার আশেপাশের অন্যদের মধ্যে এই রোগ খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।
টাইফয়েড কেন হয়
টাইফয়েড রোগ মূলত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। টাইফি ব্যাকটেরিয়া যুক্ত পানি ও খাবার খাওয়ার ফলে টাইফয়েড জ্বর হয়৷ এই ব্যাকটেরিয়া মূলত বাসা-বাড়িতে সরবরাহ করা পানি ও সিউয়েজ লাইন থেকে ছড়ায়। এছাড়া টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীর মলমূত্র থেকেও টাইফি ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
একবার দূষিত পানি ও খাবারে সাথে টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া মানুষের দেহে প্রবেশের পর তা কয়েক সপ্তাহ অন্ত্রের মধ্যে থাকে। সেখানে এই ব্যাকটেরিয়া পুরোপুরি শক্তিশালী হওয়ার পর তা অন্ত্রের গাত্র ও রক্তনালির মধ্য দিয়ে দেহের অন্যান্য কোষ ও অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। টাইফি ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের দেহের ইমুউন সিস্টেম খুব বেশি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। ফলে খুব সহজেই এই ব্যাকটেরিয়া মানুষকে কাবু করে ফেলে।
টাইফয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৩-৫% ব্যক্তি এই ব্যাকটেরিয়া বহনকারী হিসেবে কাজ করে থাকে। বাকিদের অনেকে সামান্য মাত্রা আক্রান্ত হয়৷ কেউ কেউ আবার টাইফি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। কিন্তু এদের শরীরে দীর্ঘদিন এই ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে। পরবর্তী সময়ে এদের মাধ্যমেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ
ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ৬ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ সমূহ প্রকাশ হতে শুরু করে। টাইফয়েডের প্রধান দুটি লক্ষণ হলো জ্বর ও শরীরে লালচে ফুসকুড়ি। টাইফয়েড আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বরের মাত্রা সাধারণ জ্বরের চেয়ে অনেক বেশি হয়। জ্বর ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে ১০৩-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠে যায়৷ জ্বরের পাশাপাশি ঘাড় ও তলপেটে লালচে রঙের ফুসকুড়ি উঠে থাকে৷ তবে টাইফয়েডে আক্রান্ত সকলেরই ফুসকুড়ি উঠে না।
এর বাইরে টাইফয়েড আক্রান্ত ব্যক্তির প্রচণ্ড মাথাব্যথা, গলাব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও শরীর দুর্বল হয়। অনেক টাইফয়েড রোগীর ডায়রিয়া ও বমি হয়। টাইফয়েড যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে তাহলে অন্ত্রে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। যা থেকে অন্ত্রের ঝিল্লিতে প্রচণ্ড প্রদাহ হয়। তবে এই ঘটনা খুবই কম সংখ্যক রোগীর সাথে হয়ে থাকে। আরেক ধরনের টাইফয়েড রয়েছে যাকে বলা হয় প্যারা টাইফয়েড। এই রোগের লক্ষণসমূহ টাইফয়েড রোগের মতোই। কিন্তু এটা টাইফয়েডের চেয়ে কিছুটা দুর্বল।
টাইফয়েড টেস্ট
সাধারণত রক্ত, মল ও মূত্রের পরীক্ষার মাধ্যমে টাইফয়েড নির্ণয় করা হয়। রোগীর এসব নমুনা মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে পরীক্ষা করে সালমোনেলা টাইফি ভাইরাসের উপস্থিতি আছে কিনা তা যাচাই করা হয়। অনেক সময় প্রথমবারের পরীক্ষায় টাইফয়েড ধরা পড়ে না। এ কারণে বেশ কয়েকবার একই ধরনের পরীক্ষা করে টাইফয়েড হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা হয়।
তবে বোন ম্যারো পরীক্ষার মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে টাইফয়েড নির্ণয় করা যায়। কিন্তু পরীক্ষা ও নমুনা গ্রহণ, উভয়ই বেশ জটিল ও কষ্টকর। তাই অন্য পরীক্ষায় যদি কোনোভাবে টাইফয়েড ধরা না পড়ে তবেই বোন ম্যারো টেস্ট করা হয়। যদি পরিবারের একজনের টাইফয়েড ধরা পড়ে তাহলে অন্য সদস্যদেরও টাইফয়েড পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কেননা টাইফয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যরা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
টাইফয়েড হলে করণীয়
রক্ত পরীক্ষা: টাইফয়েড পানিবাহিত জীবাণুর মাধ্যমে ছড়ায়। তাই টাইফয়েডের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে সবার আগে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। রক্ত পরীক্ষা থেকে নিশ্চিত হতে হবে টাইফয়েড হয়েছে কিনা।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে: টাইফয়েড হওয়ার অন্যতম কারণ নোংরা পরিবেশ। তাই টাইফয়েড রোগ থেকে দূরে থাকতে হলে এবং টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে পরিষ্কার পোশাক পরিধান করতে হবে। নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। ফলমূল ধুঁয়ে খেতে হবে। ঘরের সকল জিনিসপত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র আলাদা করে রাখতে হবে।
পানি ও খাবারে সতর্কতা: টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। ঠাণ্ডা কোনো খাবার খাওয়া যাবে না৷ প্রয়োজনে গরম করে খেতে হবে। অপরিষ্কার শাক-সবজি ও ফলমূল খাওয়া যাবে না।
বাসস্থান ও টয়লেটের ব্যবস্থা: সবসময় বাসস্থান ও টয়লেট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। টয়লেট অথবা ঘরে যেন নোংরা পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির টয়লেট ও নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিতে খোলামেলা পরিবেশে রাখতে হবে।
টাইফয়েড হলে যেসব খাবার খাবেন
চিকিৎসকদের মতে টাইফয়েডের যেকোনো রোগীর উচ্চ ক্যালোরি যুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। কেননা উচ্চ ক্যালোরি যুক্ত খাবার টাইফয়েডের কারণে ওজন হ্রাস হওয়া প্রতিরোধ করে। এ কারণে এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগীকে পাস্তা, সেদ্ধ আলু, সাদা রুটি ও কলা খেতে দিতে হবে।
টাইফয়েডের রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। কারণ টাইফয়েডের কারণে অনেক সময় ডায়রিয়া হতে পারে। যার ফলে শরীরে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। শরীরে পানির পরিমাণ কমে টাইফয়েডের চিকিৎসাতেও সমস্যা হয়। তাই টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি, প্রচুর পানিযুক্ত ফল ও অন্যান্য খাবার এবং ফলের রস খাওয়াতে হবে।
অধিক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার দিতে হবে। হালকা শক্ত ও হালকা নরম জাতীয় খাবার সহজেই পরিপাক হয়। এ জন্য টাইফয়েডের রোগীদের ভাত, ভাজা আলু ও ডিম পোচ খেতে দিতে হবে। এই খাবারগুলো টাইফয়েডেে রোগীদের জন্য খুবই উপকারী।
টাইফয়েডে আক্রান্তদের প্রচুর পরিমাণে দুগ্ধজাত খাবার খেতে হবে। পাশাপাশি তাদের খাঁটি মধু খাওয়ালে দ্রুত রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করবেন।
টাইফয়েড রোগীর ডায়েটে অবশ্যই দই ও ডিম রাখতে হবে। এগুলো খুব তাড়াতাড়ি পরিপাক হয়। যা টাইফয়েড রোগীদের দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে সহায়তা করে। পাশাপাশি দেহের প্রোটিনের অভাব পূরণ করে। তবে যারা নিরামিষভোজী তারা দই ও ডিমের পরিবর্তে মসুরের ডাল, মাষকলাই ও কটেজ চিজ খেতে পারেন।
যেসব খাবার খাওয়া যাবে না
টাইফয়েড রোগীদের প্রচুর পরিমাণে আঁশযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। এ ধরনের খাবার হজম হতে অনেক সময় লাগে।
ক্যাপসিকাম ও বাঁধাকপির মতো গ্যাস সৃষ্টিকারী সবজি পরিহার করতে হবে। এই খাবারগুলো পেটে গ্যাস তৈরি করে এবং পেট ফেঁপে যায়।
রসুন ও পেঁয়াজ বেশি খাওয়া যাবে না। এমন ফ্লেভারযুক্ত অন্য কোনো সবজিও খাওয়া যাবে না।
মসলাদার ও এসিটিক এসিড সৃষ্টিকারী খাবার খাওয়া খাবে না। যেমন: হট সস, কাঁচামরিচ ও ভিনেগার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
ঘি, মাখন, ডেজার্ট ও ভাজাপোড়া খাবার পরিহার করতে হবে।
টাইফয়েডের চিকিৎসা
টাইফয়েড সাধারণত ৩-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়৷ তবে ক্ষেত্র বিশেষে আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। টাইফয়েডের চিকিৎসা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো সাধারণত টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। সচরাচর এই রোগের চিকিৎসায় সিপ্রোফ্লোক্সাসিন (সিপ্রো), অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও সেফট্রিয়াক্সোন।
যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত গর্ভবতী ব্যতীত অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসকরা সিপ্রোফ্লোক্সাসিন দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশেও টাইফয়েডের রোগীদের এই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না। বাদ নেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও। যে সকল রোগী সিপ্রোফ্লক্সাসিন নিতে পারেন না কিংবা এই অ্যান্টিবায়োটিক যাদের শরীরে কোনো কাজ করে না তাদের টাইফয়েড চিকিৎসায় অ্যাজিথ্রোমাইসিন দেওয়া হয়।
আর যাদের টাইফয়েডের মাত্রা অনেক বেশি এবং বাচ্চাদের সিপ্রোফ্লক্সাসিনের পরিবর্তে সেফট্রিয়াক্সোন অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনের মাধ্যম্যে শরীরে দেওয়া হয়। তবে এসব অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দীর্ঘদিন এসব ঔষুধ ব্যবহার করলে শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্ট তৈরি হতে পারে। আর টাইফয়েডের ফলে যদি কারো অন্ত্রে ছিদ্র হয় তাহলে তাকে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে অস্ত্রোপচার করতে হবে।
টাইফয়েডের ভ্যাকসিন
টাইফয়েড প্রতিরোধ করার জন্য মূলত দুই ধরনের ভ্যাকসিন রয়েছে। এক. ভিআই অ্যান্টিজেন বা ভিআই-পিএস (Vi-PS) ভ্যাকসিন। অপরটি হলো টিওয়াই-২১ ভ্যাকসিন। ভিআই ভ্যাকসিন সাধারণত ইনজেকশনের মাধ্যমে একবার দেওয়া হয়। যা প্রায় ৩ বছর পর্যন্ত ৭০ ভাগ টাইফয়েড প্রতিরোধ করে। অপরদিকে টিওয়াই-২১ ভ্যাকসিন ক্যাপসুল আকারে খেতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন দিনে মোট তিনটি ক্যাপসুল খেতে হয়। এই ভ্যাকসিন দীর্ঘদিন টাইফয়েডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম।
টনসিল শব্দটি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। গলায় সামান্য ব্যথা বলেই আমরা মনে করি টনসিলের সমস্যা হয়েছে। কিন্তু টনসিল আসলে কী? টনসিল আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি অংশ। গলার পেছনের দিকে এবং মুখের ভেতরে মোট চারটি অংশে বিভক্ত। এই চারটি অংশের নাম হলো লিঙ্গুয়াল, প্যালাটাইন, টিউবাল ও অ্যাডেনয়েড৷
টনসিল আমাদের শরীরে ফিল্টারের মতো কাজ করে। এটি বিভিন্ন ধরনের জীবাণুকে আটকে দেয়। যেগুলো শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে ইনফেকশন তৈরি করতে পারে। এছাড়া টনসিল অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু কখনো কখনো অতিরিক্ত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে টনসিল নিজেই ইনফেকশনের শিকার হয়। যাকে বলা হয় টনসিলাইটিস। টনসিলের চারটি অংশের যেকোনো একটিতে প্রদাহ হলে তাকে টনসিলাইটিস বলে।
টনসিল বলতে আমরা সাধারণভাবে যেটা বুঝি সেটাই টনসিলাইটিস। এটা সচরাচর শিশুদের হয়ে থাকে। তবে শিশু ছাড়াও অন্যান্য বয়সী মানুষেরও টনসিলাইটিস হতে পারে৷ টনসিলের চারটি অংশের মধ্যে প্যালাটাইন টনসিলে অধিক পরিমাণ প্রদাহ সৃষ্টি হয়। যার ফলে আমাদের গলাব্যথা হয়। প্যালাটাইন টলসিলের প্রদাহ আবার দুই রকমের হয়ে থাকে। একটি তীব্র বা অ্যাকিউট৷ আর দীর্ঘমেয়াদী বা ক্রনিক টনসিলাইটিস।
টনসিলের কারণ
ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণের কারণে টনসিলাইটিস বা টনসিলের সমস্যা হয়ে থাকে। তবে টনসিলের জন্য প্রধানত স্ট্রেপটোকক্কাস (স্ট্রেপ) ব্যাকটেরিয়া দায়ী৷ এছাড়া টনসিলের জন্য অন্যান্য যে সকল ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া দায়ী:
অ্যাডেনো ভাইরাস
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস
এপস্টেইন-বার ভাইরাস
প্যারা-ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস
এনটারো ভাইরাস
হার্পস সিম্পলেক্স ভাইরাস
টনসিলের লক্ষণ
টনসিলাইটিসের সাধারণ লক্ষণ হলো টনসিলে জ্বালাপোড়া ও ফুলে যাওয়া৷ এছাড়াও টনসিলাইটিসের হওয়ার আগে যেসব লক্ষণ দেখা যায়:
গলায় প্রচণ্ড ব্যথা
টনসিল লাল হওয়া
খাবার খেতে কষ্ট ও মুখ হাঁ করতে ব্যথা অনুভূত হওয়া
গলার মধ্যে তীব্র ব্যথাযুক্ত ফোস্কা বা ক্ষত সৃষ্টি হওয়া
মাথাব্যথা হওয়া
কানেও ব্যথা হতে পারে
শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া
খাবারে অরুচি
মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হওয়া
বমিবমি ভাব হওয়া
পেটে ব্যথা হওয়া
ঢোঁক গিলতে কষ্ট হওয়া
স্বরভঙ্গ
গলা ফুলে যাওয়া
টনসিলের ঘরোয়া চিকিৎসা
প্রাথমিকভাবে টনসিলের সমস্যা হওয়ার পর প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে। এবং সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। এছাড়া টনসিল নিরাময়ের জন্য ঘরোয়া বেশ কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে।
১. লবণ পানি দিয়ে কুলকুচি করা
কুসুম গরম পানিতে লবণ দিয়ে কুলকুচি ও গড়গড়া করলে টনসিলের কারণে গলার ব্যথা প্রশমিত হয়৷ এছাড়া গলার মধ্যে যে জ্বালাপোড়া হয় সেটা কমাতে সাহায্য করে। একই সাথে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বন্ধ করতে সহায়তা করে। এক গ্লাস পানিতে আধা চা চামচ লবণ মিশিয়ে কয়েক সেকেন্ড করে কয়েকবার কুলকচি করতে হবে।
২. যষ্টিমধু
যষ্টিমধুতে প্রদাহ কমানোর উপাদান থাকায় টনসিলের জন্য এটি খুবই উপকারী। মুখের মধ্যে সামান্য যষ্টিমধু নিয়ে চিবাতে হবে। এর মাধ্যমে একই সাথে গলা ও টনসিলের প্রদাহ উপশম হয়ে থাকে৷ যদি হাতের নাগালে যষ্টিমধু না পান, তাহলে এর উপাদান সমৃদ্ধ লজেন্স কিনতে পাবেন। এই লজেন্স খেলেও টনসিলের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়৷ তবে কেনার সময় অবশ্যই ভালো মানের লজেন্স কিনতে হবে। বাচ্চাদের টনসিলের সমস্যা হলে এই লজেন্স খেতে দেওয়া যাবে না। কেননা গলায় আটকে যেতে পারে। এর পরিবর্তে টনসিলের জন্য ‘থ্রোট (গলা) স্পে’ ব্যবহার করতে পারেন।
৩. মধু দিয়ে চা
চা অথবা অন্য কোনো গরম পানীয় টনসিলের কারণে গলায় সৃষ্ট হওয়া অস্বস্তি দূর করতে সাহায্য করে। চায়ের সাথে মধু যোগ করলে আরো বেশি উপকার পাওয়া যায়। কেননা মধুতে রয়েছে শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী উপাদান। যার ফলে ব্যাকটেরিয়ার কারণে টনসিলাইটিস সংক্রমণ হলে দ্রুত ফল পাওয়া যায়।
গরম চায়ের সাথে মধু মিশিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে৷ মধু যখন চায়ের সাথে মিশে যাবে তখন পানির মতো চুমুক দিয়ে খেতে হবে। এছাড়া টনসিল নিরাময়ের জন্য আদা চা ও পুদিনা পাতার চা বেশ কার্যকরী।
৪. ঠাণ্ডা জাতীয় খাবার
ফ্রিজে রাখা দই অথবা আইসক্রিমের মতো ঠাণ্ডা ও নরম খাবার খেলে সাময়িকভাবে টনসিলের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কেননা এই জাতীয় খাবার গলার মধ্যে ব্যথার অনুভূতিকে অসাড় করে দেয়৷ এর জন্য অনেকে আইস পপ, ঠাণ্ডা পানীয় ও ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খেয়ে থাকেন। একই ধরনের ফল পাওয়ার জন্য চাইলে মিন্ট (পুদিনা) বা মেনথল যুক্ত চুইংগাম বা লজেন্স খেতে পারেন।
৫. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
টনসিলাইটিস হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। কেননা ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের সাথে লড়াই করতে হলে পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। এই রোগকে হালকাভাবে না নিয়ে সুস্থ মানুষের মতো স্কুল, কলেজ বা অফিসে যাওয়া উচিত নয়। কয়েকদিনের পূর্ণ বিশ্রাম না নিয়ে অন্য সময়ের মতো কাজ করলে টনসিলাইটিস বেড়ে যেতে পারে। একই সাথে আশেপাশে থাকা অন্য মানুষজন এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
টনসিল হলে যা খাবেন
মধু: টনসিলের সমস্যায় মধু খু্বই কার্যকরী। বিশেষ করে টনসিলের সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং রাতে ভালো ঘুমের জন্য মধু খুবই উপকারী। এছাড়া মধু কফের ঔষুধ হিসেবে কাজ করে। টনসিলে আক্রান্ত হলে চা অথবা গরম লেবু পানির সাথে মধু পান করলে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যায়।
কলা: কলা পুষ্টিকর, নরম এবং সহজে গেলা যায়। টনসিলে আক্রান্ত রোগীর যেহেতু শক্ত খাবার খাওয়া নিষেধ। সেজন্য কলার সাথে আরো কিছু নরম ফলমূল মিশিয়ে খেলে টনসিলের উপর চাপ কম পড়বে। একই সাথে ক্ষুধা নিবারণ করা সম্ভব।
সুপ: টনসিলের রোগীদের জন্য গরম সুপ উত্তম খাবার। সুপের মধ্যে শস্য দানার ভাত, গাজর, শিম বা অন্য কোনো সবজি কুচিকুচি করে কেটে সেদ্ধ করে সুপের সাথে মিশিয়ে খেলে শরীরের পুষ্টির চাহিদা মিটবে। এছাড়া টনসিল থেকে অল্প সময়ে আরোগ্য লাভ করার জন্যও সুপ কার্যকরী।
নরম পাস্তা: কলার মতো পাস্তা সহজে গেলা যায়। তাই টনসিল হলে ক্ষুধা নিবারণের জন্য ভাতের পরিবর্তে নরম পাস্তা খাওয়া ভালো। চাইলে সুপের সাথে পাস্তা মিশিয়ে খেতে পারেন।
ডিম ভর্তা: ডিম সেদ্ধ করে পেঁয়াজ, মরিচ ছাড়া ছাড়া ভর্তার মতো করে আলুর সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। কেননা এই খাবারটি টনসিলে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। কিন্তু শরীরে শক্তি যোগাতে ডিম ও আলু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
টনসিল হলে যা খাবেন না
টমেটো সস: টমেটো দিয়ে তৈরি টমেটো কেচাপ কিংবা পিৎজা সস খেলে টনসিলের সমস্যা আরো বাড়তে পারে। কারণ টমেটো সস জাতীয় খাবার খুবই এসিডিক। তাই টনসিলের রোগীদের এই খাবার এড়িয়ে চলাই উত্তম।
মসলাদার খাবার: টমেটো সসের মতোই মরিচ কিংবা রসুন যুক্ত যেকোনো খাবার টনসিলের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। এই মসলাগুলো গলার মধ্যে অস্বস্তিকর কাশি ও কফের সৃষ্টি করে গলার ব্যথা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এসব মসলাদার খাবার টনসিলের সমস্যা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বাদ রাখতে হবে।
শক্ত খাবার: হালকা নাস্তায় পপকর্ন, আলুর চিপস কিংবা ক্র্যাকার্স বাদ দিতে হবে। এই খাবারগুলো টনসিলের সমস্যাকে দীর্ঘমেয়াদী করে তুলতে পারে। সেই সাথে গলায় ব্যথা বাড়াতে পারে।
টক ফল: কমলা বা মাল্টার মতো অন্যান্য টক স্বাদযুক্ত ফলে এসিড থাকে, যা গলার প্রদাহ বাড়িয়ে দেয়। তাই এই খাবারগুলো না খাওয়াই উত্তম। এমনকি এসব ফলের রস খাওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে।
টোস্ট বিস্কুট: মচমচে টোস্ট বিস্কুট খাওয়ার পরিবর্তে নরম পাউরুটি খেতে হবে। চাইলে রুটি দুধে ভিজিয়ে খেতে পারেন। টনসিলের আক্রান্ত রোগীদের কফি ও মদ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এই দুটি পানীয় টনসিলের জন্য ক্ষতিকর। এসব পানীয় পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে।
টনসিলের চিকিৎসা
টনসিলের চিকিৎসার শুরুতে সাধারণত ব্যথানাশক ঔষধ দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে যদি টনসিলের সমস্যা হয় তাহলে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। অবশ্যই এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত খেতে হবে। টনসিলের সমস্যা ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও। কেননা অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করার পর কোর্স শেষ না করলে পরবর্তীতে আবারো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি কিডনির সমস্যাও হতে পারে।
আগে টনসিলের সমস্যায় অস্ত্রোপচার করা নিয়মিত ঘটনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসারা পরিস্থিতি বুঝে টনসিলের অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন। বিশেষ করে একজন মানুষ যদি বছরে ৭ বার অথবা বছরে ৩ বার করে টানা ৩ বছর টনসিলের সমস্যায় আক্রান্ত হন তাহলে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন৷ কিন্তু টনসিল যেহেতু আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়া উচিত নয়।
যদি অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোনো সমাধান না থাকে তাহলে ভালো কোনো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উত্তম। বর্তমানে টনসিলের অপারেশনের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে থেকে সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি বেছে নেওয়া ভালো৷ টনসিলের সমস্যায় অস্ত্রোপচার শেষ চিকিৎসা। সাধারণত এই সমস্যায় অস্ত্রোপচার করার হার খুবই কম। তাই টনসিল হলে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
টনসিল প্রতিরোধ
টনসিলেল সমস্যা থেকে দূরে থাকার জন্য এর প্রতিরোধ করতে হবে। টনসিল প্রতিরোধ করার জন্য দিনে কয়েকবার হাত পরিষ্কার করতে হবে। নিজের খাবার, পানীয় বা অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্রকে অন্যকে ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত না। এছাড়া যারা টনসিলের সময় ভুগছেন তাদের থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।
Source:
https://www.healthline.com/health/home-remedies-for-tonsilitis#warm-tea-and-honeyhttps://www.webmd.com/oral-health/tonsillitis-symptoms-causes-and-treatments#1https://www.everydayhealth.com/tonsillitis/home-remedies-fast-recovery/
আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবনে সময়ের হিসাব মেলানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন সময়ের সদ্ব্যবহার করলেই জীবনে সফলতা অর্জন করা সম্ভব৷ কিন্তু আমরা অনেকেই দিন-রাত্রির বড় একটি সময় বিছানায় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই। কেউ কাজের প্রতি অনীহা করে ঘুমান, আবার কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে।
চিকিৎসকদের ভাষায় একজন মানুষের সুস্থ থাকার জন্য ৮ ঘণ্টার ঘুমই যথেষ্ট। কোনো কোনো চিকিৎসকের মতে আবার সেটি ৮ ঘণ্টারও কম। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন শুধুমাত্র রাতেই ৮ ঘণ্টার বেশি ঘুমান। পাশাপাশি অনেকের দিনে ঘুমানোর অভ্যাস রয়েছে। অতিরিক্ত ঘুমের কারণে দিনের বড় একটি সময় নষ্ট হয়। অথচ এই সময়ে আমরা অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারি। পরিমিত ঘুমের পর বাকি সময়ের সদ্ব্যবহার আমাদের সাফল্য পেতে সহায়ক হতে পারে। সুস্থ ডট কমের আজকের লেখাটি ঘুম কমানোর উপায় সমূহ নিয়ে সাজানো হয়েছে।
অতিরিক্ত ঘুমের কারণ
সাধারণত রাতে অপর্যাপ্ত ঘুম, ঘুমের সময়সূচি পরিবর্তন এবং স্লিপ অ্যাপনিয়ার মতো বিভিন্ন স্লিপিং ডিসঅর্ডারের কারণে দিনে অতিরিক্ত ঘুম হয়। সপ্তাহ কিংবা মাসের মধ্যে তিন থেকে চারদিন এমন ঘটলে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া যায়৷ তবে কেউ যদি নিয়মিতভাবে দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুমায় তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কেননা ব্রেন এবং দেহের বিভিন্ন অবস্থার পরিপেক্ষিতেও অতিরিক্ত ঘুমানোন প্রবণতা দেখা যায়৷ পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনার জন্য অতিরিক্ত ঘুম হয়৷ যেমন, কোনো শব্দ বা অন্য কোনো কারণে যদি রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে দিনে ঘুম বেশি হয়। আবার পার্কিনসনের মতো স্নায়ুতন্ত্রের রোগের কারণেও অতিরিক্ত ঘুম হয়। এর বাইরে যারা সাইকিয়াট্রিক ডিসঅর্ডারের কারণে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতায় ভোগেন তাদের মধ্যে কারো ঘুম খুব বেশি হয়, আবার কারো খুবই কম হয়।
অতিরিক্ত ঘুম শুধুমাত্র স্বাস্থ্য ও কাজের জন্য ক্ষতিকর নয়। পাশাপাশি এটি হতে পারে অন্য কোনো রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। চিকিৎসকদের মতে যারা হটাৎ করে অতিরিক্ত ঘুমের সমস্যায় ভোগেন তাদের অনেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন ইনফেকশন, অ্যাজমা, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ডিসঅর্ডার ও মেটাবলিক অ্যাবনরমালাইটিজে আক্রান্ত হন। প্রাথমিক অবস্থায় এই বিষয়টি অনেকে বুঝতে পারেন না। আবার যারা বুঝতে পারেন তারা কোনো গুরুত্ব দেন না। ভালো ঘুম অফিস কিংবা স্কুল কলেজে, পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের সাথে ভালো সময় কাটাতে সাহায্য করে। বিপরীতে অতিরিক্ত তন্দ্রা কাজের ক্ষতির পাশাপাশি বড় জটিল কোনো রোগের দিকে নিয়ে যায়। তাই নিয়মিত অতিরিক্ত তন্দ্রাভাব হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি খাবারদাবার, লাইফস্টাইল ও অভ্যাসে পরিবর্তন আনা আবশ্যক৷
দিনে কম ঘুমানোর উপায়
প্রায় সবারই দিনের বিশেষ কিছু সময়ে ঘুম ঘুম ভাব হয়। তবে কেউ কেউ দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। কখনো কাজের সময় অথবা অবসর সময়েও এই সমস্যায় ভুগতে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই সমস্যার নাম হলো হাইপারসোমনিয়া। দিনের বেলা এই সমস্যা হলেও এর শুরু হয় রাতে। মূলত রাতের বেলা অপর্যাপ্ত ঘুম অথবা অনিয়মিত ঘুমের কারণেই দিনে অতিরিক্ত ঘুমের ভাব হয়। এই সমস্যা থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারেন সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১. রাতে পর্যাপ্ত ঘুমঃ দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম হওয়ার প্রধান কারণ হলো রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া। অনেকেই রাতে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। এমনকি ভোরের দিকে ঘুমাতে যান। যে কারণে দিনে ঘুমের ভাব হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের জন্য সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের পুরো নয় ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। তবে গড়ে সবারই রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
২. বিছানা থেকে দূরত্ব তৈরিঃ ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক অ্যাভেলিনো ভার্সেলেস বলেছেন, “বিছানাকে শুধুমাত্র ঘুমানো ও যৌন মিলনের জন্য ব্যবহার করুন। বিছানায় বসে কিংবা শুয়ে পড়াশোনা, টিভি দেখা, গেমস খেলা ও ল্যাপটপ ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকুন।” এছাড়া বিছানায় কোনো হিসাব-নিকাশ ও কারো সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে দূরে থাকতে হবে।
৩. নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠাঃ যারা ঘুমের সমস্যায় ভোগেন তাদের প্রায়ই ঘুমানো ও ঘুম থেকে উঠার জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করার কথা বলা হয়৷ এমনকি সপ্তাহের শেষ দিনেও এই নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু যারা ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রায় ভুগছেন তারা নির্দিষ্ট ঘুমানোর সময় নির্ধারণ করে আরো বেশি সমস্যায় পড়তে পারেন। এ কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠার উপর জোর দিতে বলেছেন। সেটা হতে পারে এক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস।
৪. তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপর জোর দেওয়াঃ হটাৎ করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা না করে ধারাবাহিকভাবে অল্প অল্প করে সময় কমিয়ে আনা বুদ্ধিমানের কাজ। প্রতি চার রাত পরপর আগের চেয়ে ১৫ মিনিট আগে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। এরপর একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৫. নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ার অভ্যাসঃ নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোর পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়তে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সকাল ও দুপুরের খাবার খেতে হবে। রাতের খাবার খেতে হবে ঘুমানোর দুই থেকে তিন ঘণ্টা পূর্বে।
৬. ব্যায়ামঃ ভালো ঘুমের জন্য ব্যায়াম বিভিন্নভাবে সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে অ্যারোবিক এক্সারসাইজ রাতে ভালো ঘুম হতে সহায়তা করে। পাশাপাশি দিনে কাজ করার জন্য এনার্জি প্রদান করে এবং বিভিন্ন বিষয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রত্যেকের দিনের আলোতে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত।
৭. সময়সূচি তৈরিঃ যদি আপনাকে রাতে বিভিন্ন ধরনের কাজ সামলাতে গিয়ে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে সমস্যা হয়, তাহলে একটি সময়সূচি তৈরি করুন। বিভিন্ন কাজের গুরুত্ব নির্ধারণ করুন। রাতে অপ্রয়োজনীয় কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এতে আপনি ঘুমের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবেন। পাশাপাশি আপনাকে অহেতুক কাজের চাপে পড়তে হবে না।
৮. ঘুম না আসা পর্যন্ত বিছানায় না যাওয়াঃ কখনো ক্লান্ত হলেই বিছানায় গা এলিয়ে দেবেন না। এতে আপনার ভালো ঘুম হবে না। যখন ঘুমের ভাব হবে তখনই বিছানায় যাওয়া উচিত। তাই সবার আগে নিজের ক্লান্তি ও ঘুমের মধ্যে ফারাক বোঝার চেষ্টা করুন।
৯. বিকালে না ঘুমানোঃ বিকালের ঘুম রাতের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। যার ফলে দিনে কাজের সময় ঘুমের ভাব হয়। তাই বিকালেই না ঘুমানোই ভালো।
১০. ঘুমানোর আগে চিত্তবিনোদন (Relaxing): ঘুমানোর আগে বিশেষ কিছু চিত্তবিনোদন দিনের সকল ক্লান্তি দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। চিত্তবিনোদনের জন্যে গান শুনতে পারেন, বই পড়তে পারেন, হট বাথ করতে পারেন অথবা মেডিটেশন করতে পারেন। পাশাপাশি এক কাপ হারবাল চা অথবা গরম দুধ পান করতে পারেন। তবে যেসব খাবার খেলে রাতে বারবার ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, সে সকল খাবার পরিহার করতে হবে।
১১. অ্যালকোহল পরিহারঃ অনেকে মনে করেন মদ বা অ্যালকোহল জাতীয় কোনো খাবার রাতে ঘুমানোর জন্য সহায়তা করে। কিন্তু এটি পুরোপুরি ভুল। বরং অ্যালকোহলের কারণে অনিদ্রা হয়। যার প্রভাব পড়ে দিনের কাজকর্মে।
১২. বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণঃ স্লিপিং ডিসঅর্ডারের কারণে দিনে অতিরিক্ত ঘুম হতে পারে। যদি কোনোভাবে দিনে বেলায় অতিরিক্ত ঘুমের সমস্যা দূর না করা যায় তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উত্তম।
ঘুম কমানোর খাবার
গ্রিন টিঃ শরীরে পানিশূন্যতা হলে ঘুম পায়। কিন্তু বিশেষ কিছু তরল খাবার পানিশূন্যতা কমানোর পাশাপাশি জেগে থাকতে সহায়তা করে। এ জন্য পানি উত্তম তরল খাবার। তবে এর সাথে ক্যাফেইন থাকলে ঘুম দূর করা যায়। এক্ষেত্রে কফির চেয়ে গ্রিন টি বেশি উপকারী৷ কেননা কফি অপেক্ষা গ্রিনটিতে ক্যাফেইনের পরিমাণ অনেক কম। সাথে শরীরের জন্য উপকারী অ্যান্টি-অক্সিডেন্টও পাওয়া যায়।
চকোলেটঃ চকোলেট তৈরির প্রধান উপকরণ চকোয়া বিনে মনকে উৎফুল্ল ও সজাগ করার উপাদান থাকে। তবে কফি অপেক্ষা কম। বোনাস হিসেবে চকোলেটে হার্টের জন্য উপকারী ফ্লাভোনয়েড। তবে মনে রাখতে হবে, চকোলেট যত ডার্ক হবে, ক্যাফেইনের মাত্রাও তত বেশি। তাই অতিরিক্ত মাত্রায় ডার্ক চকোলেট না খাওয়াই উত্তম।
শস্যদানাঃ আমাদের শরীর কার্বোহাইড্রেট থেকে এনার্জি যোগায়। শস্যদানা থেকে মূলত কার্বোহাইড্রেট। যেমন, চাল, গম, বার্লি, ওটস, রাই ইত্যাদি। শস্যদানা খুব ধীরে ধীরে ভাঙে। এর ফলে শরীরে ধারাবাহিকভাবে শক্তি যোগাতে পারে। শরীর শক্তি থাকলে ক্লান্ত হবার সম্ভাবনা কম। মূলত ক্লান্তি থেকেই ঘুম আসে। ঘুম কমানোর জন্য পরিমিত ভাত, রুটি অথবা টোস্ট খাওয়া যেতে পারে। যেহেতু আমাদের প্রধান খাবার ভাত। তাই শস্যদানা থেকে অন্য কোনো খাবার খাওয়া খেতে পারেন।
ফলমূলঃ ফলে থাকা সুগার আমাদের শরীরে দ্রুত এনার্জি যোগায়। কিন্তু ফল খেলে শরীরের গ্লুকোজ লেভেল খুব বেশি বাড়ে না। তাই এনার্জি পাওয়ার জন্য ফল খাওয়া নিরাপদ। বিশেষ ভিটামিন -সি সমৃদ্ধ কমলা অথবা আনারস খেতে পারেন। এই ফলগুলো শরীরের চর্বিকে গলিয়ে এনার্জিতে রূপান্তিত করে।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারঃ প্রোটিন থেকে এনার্জি খুব ধীরে ধীরে পাওয়া যায়। ফলে শরীরে দীর্ঘ সময় এনার্জি পাওয়া যায়। তবে মাংস খুবই কম খাওয়া উচিত। এছাড়া খাওয়ার আগে কিছু সময় ব্যায়াম করা যেতে পারে। এতে করে ক্ষুধা বাড়ে।