জরায়ু বা যোনি, যা গর্ভাশয় নামেও পরিচিত, মহিলা প্রজনন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি গর্ভধারণ প্রক্রিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় একটি অঙ্গ। বিশেষকরে এটি গর্ভের বিকাশে সহায়তা করে। জরায়ুতে ইনফেকশন, যা জরায়ুগহ্বরের প্রদাহ নামেও পরিচিত, বিভিন্ন কারণে হতে পারে এবং মহিলাদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত নারীদের জরায়ু প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে থাকে। মূলত ভেজা ও সিন্থেটিক পোশাক অনেকক্ষণ পরে থাকার কারণে শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে এসব সংক্রমণ ঘটে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, স্ত্রী যৌনাঙ্গের সঠিক পরিচর্যা না করলে, সেখানে প্রদাহজনিত ব্যথা, যোনি থেকে রক্তপাত ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব ভাইরাস জরায়ুতে দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে, সংক্রমিত কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে তা ক্যান্সারে রূপ নেয়। তাই, মহিলাদের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
জরায়ুর রোগসমূহঃ
মহিলাদের, জরায়ুর মুখ যেখানে যোনির সাথে মিলিত হয়, তাকে সার্ভিক্স বলা হয়। যখন সার্ভিক্স উদ্দীপ্ত হয়, তখন তাকে সারভিসাইটিস বলে। সারভিসাইটিস সংক্রামক বা অসংক্রামক হতে পারে। সাধারণত যৌনবাহিত সংক্রমণের কারণে সারভিক্স উদ্দীপ্ত হয়।
এই যৌনবাহিত রোগগুলি হল-
- ক্লামিডিয়া
- গনোরিয়া
- হার্পিস
লেটেক্স অ্যালার্জি এবং ডিউসিং এর কারণেও জ্বালাভাব (প্রদাহ) সৃষ্টি হয়। যেসব মহিলা ক্যানসারের জন্য রেডিয়েশন থেরাপি নিচ্ছেন তাদেরও সার্ভিক্সের মধ্যে জ্বালাভাব দেখা দিতে পারে। এতে যদি মূত্রনালী সংক্রমিত হয় তবে আক্রান্ত মহিলাটি মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা অনুভব করতে পারেন। যোনিতে চুলকানি অথবা যোনি থেকে রক্তপাতও হতে পারে। বিশেষত যৌন সংসর্গের পরে অথবা মাসিক চক্রের মধ্যখানে অনেক সময় পেটের যন্ত্রণা দেখা দিতে পারে।
এইচপিভি-ও জরায়ু রোগসমূহের মধ্যে অন্যতম। এর ফলে দেহে আঁচিল, গুটি বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়- যা যৌনাঙ্গ থেকে শুরু করে মুখে, হাতে-পায়ে এমনকি মুখের ভেতরেও হতে পারে। এ ভাইরাস খুবই ছোঁয়াচে। সাধারণত নারী পুরুষ যখন প্রথম যৌন-সক্রিয় হয়ে ওঠে তখনই এ সংক্রমণের শিকার হয়।
জরায়ুতে জ্বালাপোড়া
ইনফেকশান হলে জরায়ু জ্বালাপোড়া করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় জরায়ুর ওজন বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্লাডারে চাপ পড়ে। এতে প্রস্রাব ঠিক মতো বেরোতে পারে না। এক্ষেত্রে সাবধান না হলে কিডনির উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি সময়ের আগেই প্রসূতি বেদনা শুরু হয়। অস্বাভাবিক কম ওজনের শিশু জন্মানোরও ঝুঁকি থাকে। প্রেগন্যান্সির সময় কেটে গেলেও ইউরিনারি ট্রাক্ট (urinary tract) বা ব্লাডার ইনফেকশনের (bladder infection) ঝুঁকি থেকে যায়। প্রস্রাবের সময় জ্বালা করে, তলপেটে চাপ এবং বারবার প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।
চলুন দেখে নিই আর কি কি কারণে জরায়ুমুখে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি হতে পারে –
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানিপান না করার ফলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে। মূলত পানি আমাদের দেহের বেশীর ভাগ রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে। এজন্য প্রতিদিন আমাদের পরিমিত পরিমাণে পানি পান করা উচিৎ।
- নারীদের ক্ষেত্রে এই উপর্সগটি বেশ কষ্টদায়ক। মেয়েদের পায়ুপথের খুব কাছেই মূত্রনালী অবস্থিত। যার ফলে পায়ুপথের মাধ্যমে অনেক ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস মূত্রনালীতে প্রবেশ করে এবং জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে।
- মাসিক বা পিরিয়ডের কারণেও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে। অনেকে সে সময় অস্বাস্থ্যকর ন্যাপকিন কিংবা কাপড় ব্যবহার করে। এসব ন্যাপকিন বা কাপড়ের সাথেও জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালিতে প্রবেশ করে সংক্রমণের সৃষ্টি করতে পারে।
জরায়ু ব্যথার কারণঃ
মহিলাদের অনেকে তলপেটে ব্যথা এবং নিতম্বের ব্যথায় ভোগেন। বিশেষ করে মাসিক হওয়ার আগে তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। মাসিক হওয়ার সময় এ ব্যথা খুব বেড়ে যায়।
পিরিয়ড জনিত দীর্ঘমেয়াদি এ ব্যথা মূলত জরায়ু প্রাচীরের চারদিকে প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে।
গর্ভাবস্থায়ও যোনিতে ব্যথার সৃষ্টি হয়। এর কয়েকটি কারণ-
জরায়ুর বৃদ্ধি: গর্ভাবস্থায় যোনিতে ব্যথার এটি সাধারণ কারণ। জরায়ু ভ্রূণের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গিয়ে আকারে বেড়ে যায়। ফলে এটি যোনি ও আশেপাশের পেশীগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে।
হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থা নারীদেহে হরমোনের পরিবর্তন ঘটায়। এটি যোনিকে অযাচিতভাবে শুষ্ক করে তোলে। এর ফলে যোনিতে ব্যথা সৃষ্টি হয়; বিশেষত যৌন মিলনের সময়।
ভ্রূণের বৃদ্ধি: জরায়ুতে ভ্রূণের আকার বাড়ার সাথে সাথে নিতম্বের লিগামেন্টগুলিও প্রসারিত হয়। যোনিকে ঘিরে থাকা লিগামেন্ট এবং পেশীর অত্যধিক প্রসারণের ফলে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা দেখা দেয়। শিশুর ওজন পেলভিক মেঝেতে চাপ তৈরি করার ফলেও যোনিতে ব্যথা সৃষ্টি হয়।
সংক্রমণ: সংক্রমণের কারণে বাহ্যিক যৌনাঙ্গে এবং যোনিতে ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। এসব লক্ষণ প্রকাশ পেলে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। গর্ভাধারণকালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বিধায়, এসময় মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জরায়ুর বিভাজন: জরায়ুর প্রসারণের ফলে যোনিতে তীক্ষ্ণ এবং শ্যুটিংয়ের ন্যায় ব্যথা হতে পারে। তবে, ব্যথা যদি তলপেটে হয় এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে তবে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিৎ।
পেলভিক অরগান প্রোল্যাপস (পিওপি): পিওপি হল গর্ভাবস্থাকালীন এমন একটি অবস্থা যেখানে শ্রোণী বা তার আশেপাশের অঙ্গগুলি কখনও কখনও যোনি বা মলদ্বারে প্রবেশ করে। আপনি যদি তীব্র চাপ অনুভব করেন, অন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধা হয়, তবে অবিলম্বে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। পিওপি চিকিৎসাযোগ্য, তবে এটি মারাত্মক ব্যথা ও জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।
এক্ষেত্রে করণীয়:
- ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমান। এতে আপনার রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে এবং যোনি চাপমুক্ত থাকবে
- একইভাবে, আপনার পা উঁচু জায়গায় রেখে বসুন। গর্ভাবস্থায় যোনিপথের চাপ অনেকাংশে হ্রাস করতে এটি সহায়ক। ফলে যোনিতে ব্যথাও কমে যায়।
- সাঁতার এবং যোগ ব্যায়ামের মতো সাধারণ অনুশীলনগুলি শরীরে রক্ত চলাচল বাড়াতে এবং পেশী শক্তিশালী করতে অনেক কার্যকর। এভাবে যোনির ব্যথা অনেকখানি উপশম করা সম্ভব।
- নিয়মিত কেগেল এক্সারসাইজ করলে যোনির চাপ ও ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
- যদি আপনার পেট বিশাল হয়, তবে বুঝে নিবেন এটি শিশুর মাথা যোনিতে চাপ দেয়ার ফলে হচ্ছে। গর্ভাবস্থায় সাপোর্ট বেল্ট পরলে সেই চাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
- গর্ভাবস্থায় যোনিতে ব্যথা অস্বস্তিকর হতে পারে যদিও এটি মহিলাদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা। জীবনযাত্রার কয়েকটি পরিবর্তন যোনির ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। তবে আপনি যদি মনে করেন, ব্যথা স্বাভাবিকের চেয়েও খারাপ, তবে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
জরায়ু মুখের ইনফেকশন কি?
জরায়ু ইনফেকশন বা পিআইডি (পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ) বলতে ডিম্বনালীতে জীবাণুর সংক্রমণকে বোঝায়। এটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাক সহ বিভিন্ন জীবাণুর কারণে হতে পারে। মাঝে মাঝে এটি ডিম্বাশয়কেও আক্রান্ত করতে পারে। যৌনবাহিত রোগের (এর মধ্যে chlamydia and gonorrhoea অন্যতম) কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব সংক্রমণ হয়ে থাকে। আবার ডি অ্যান্ড সি, কপার টি, অ্যান্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসি, হিস্টারোসাল-ফিঙ্গোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষার কারণেও জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। এর ফলে প্রজনন অঙ্গগুলোর জটিলতা, গর্ভধারণ সংক্রান্ত সমস্যা এবং অন্যান্য সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়।
জরায়ুতে ইনফেকশন কেন হয়?
জরায়ুতে ইনফেকশনের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে।
- যৌন সংক্রামিত রোগ (STD): ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়া এবং ট্রাইকোমোনিয়াসিস জরায়ুতে ইনফেকশনের সাধারণ কারণ।
- যোনি ব্যাকটেরিয়োসিস (BV): এটি যোনিতে থাকা “ভালো” ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হলে ঘটে।
- অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার: দীর্ঘ সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে যোনিতে “ভালো” ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
- গর্ভপাত: গর্ভপাতের পর জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- আইইউডি ব্যবহার: ইন্ট্রা-ইউটেরাইন ডিভাইস (IUD) ব্যবহার জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি সামান্য বৃদ্ধি করতে পারে
অবিবাহিত মেয়েদের জরায়ু ইনফেকশন কেন হয়?
অবিবাহিত মেয়েদের জরায়ু ইনফেকশনের কিছু সম্ভাব্য কারণ:
- অস্বাস্থ্যকর যৌন অভ্যাস: যৌনতা চলাকালীন সুরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার না করা, যেমন কনডম, জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- অপরিষ্কার পরিবেশে সাঁতার কাটা: অপরিষ্কার পানিতে সাঁতার কাটলে জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
- অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার: অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার করলে জরায়ুতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
জরায়ু ইনফেকশনের লক্ষণঃ
অন্যান্য কারণের পাশাপাশি জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনের জন্যও জরায়ু ইনফেকশন হতে পারে। এর ফলে তলপেটে এবং কোমরের নিচে ব্যথা হয় এবং সে ব্যথা লাগাতার চলতে থাকে। এ রোগের কিছু পরিচিত লক্ষণ হলো: এবনরমাল স্রাব, জ্বর, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি।
আরো কিছু লক্ষণঃ
- অনিয়মিত মাসিক এবং জ্বর জ্বর লাগা
- মাসিকের সময় তীব্র যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা
- সহবাসে ব্যথা অনুভূত হওয়া
- মল-মূত্র ত্যাগ কালে যৌনাঙ্গ দিয়ে রক্ত বের হয় ও ব্যথা হয়।
- হাত, পা, শরীর আগুনে পোড়ার মত জ্বালা করে
- প্রস্রাবের সময় ও পরে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক বেদনা
- জরায়ুর গ্রীক ফোলা ও শক্ত থাকা
- কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অত্যন্ত ক্লান্তিকর অনুভূতি
এই লক্ষণগুলোর তীব্রতা কম বা বেশি হতে পারে। এমনকি অনেক সময় কোনো ধরনের লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও আপনি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কারণ এ রোগের জীবাণুগুলো জরায়ুর মুখে সুপ্ত অবস্থায়ও থাকতে পারে।
গর্ভাবস্থায় জরায়ু ইনফেকশনের লক্ষণ:
- যোনি থেকে অস্বাভাবিক স্রাব
- যোনিতে চুলকানি ও জ্বালাপোড়া
- পেটে ব্যথা
- মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা
- যোনি থেকে রক্তপাত
কিভাবে সংক্রমণ ঘটে?
জরায়ু সাধারণত ক্ল্যামাইডিয়া, ই. কলাই, স্ট্যাফাইলোকক্কাস, ব্যাকটেরয়েডস, গনোরিয়া ইত্যাদি জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে থাকে। জীবাণুগুলো যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে পুরুষের শুক্রাণু ও ট্রাইকোমোনাড (যা পুরুষের যৌনাঙ্গে থাকে) বাহিত হয়ে যৌনাঙ্গে প্রবেশ করে। পরে জরায়ু, নালী হয়ে ডিম্বাশয়েও এসব ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
নারীদের যৌনাঙ্গে অবস্থিত সার্ভিক্স(cervix) ব্যাকটেরিয়াকে ইউরেটাসে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। সন্তান জন্মদান কিংবা সার্জারির সময় কার্ভিক্স খোলা থাকে বিধায়, এসময়ও ব্যাকটেরিয়া সহজে জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে।
ডায়াগনোসিসঃ
এ রোগ নির্ণয়ের জন্য ল্যাব টেস্টের প্রয়োজন পড়ে। জরায়ুর মুখ বা মূত্রনালী থেকে ডিসচার্জ নিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে জীবাণুর উপস্থিতি নিরূপণ করা হয়। এছাড়া সংক্রমণের লক্ষণ বোঝার জন্য রক্ত, ইউরিন পরীক্ষা ও অ্যাবডমিনাল আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ল্যাপারস্কপি পরীক্ষার মাধ্যমেও জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
প্রতিবছর দেশে প্রায় ৯ হাজার নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বাস করা মহিলাদের জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। গ্রামীণ নারীরা তাদের নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নন। প্রথমে জরায়ু-তে ইনফেকশন, এবং পরে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে ক্যান্সারে রূপ নেয়। অনেকে লজ্জার কারণে চিকিৎসাও নিতে চায় না। তারা শরীরে রোগ পুষে রাখে। অনেক সময় মারাত্মক ইনফেকশনের ফলে রোগীকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অপরিণত বয়সে বিয়ে এবং ঘন ঘন প্রেগন্যান্সি বা ডেলিভারির কারণে জরায়ু ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। যেসব মেয়েরা বহুগামী কিংবা স্বামীরা অনেকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে এমন ক্ষেত্রেও নারীদের এইচপি (Human Papilloma Virus) ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
জরায়ু ইনফেকশনের ঔষধঃ
প্রাথমিক অবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক এবং পেইন কিলার দিয়ে জরায়ু ইনফেকশনের চিকিৎসা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ওষুধগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় খেতে হবে।
- অ্যান্টিবায়োটিক: ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের জন্য
- অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ: ছত্রাকের সংক্রমণের জন্য
- ভাইরাসবিরোধী ওষুধ: ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য
জরায়ু সংক্রমণের প্রতিকারে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকস্:
- Pulmocef 1500
- Zomycin 250
- Zybact 250 Mg
- Cefadur CA 250 Mg
- Zycin 250 mg
- ALTAXIME 500MG
- Cef 250 ইত্যাদি।
যদি এসব অ্যান্টিবায়োটিকস্ সেবনের পরও কোনো উন্নতি দেখা না যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে আপনি অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সার্জারি করার দরকার হতে পারে; যেমন: ডিম্বনালী সংক্রমিত হয়ে পুঁজের সৃষ্টি হলে এবং বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায়। এছাড়া যাদের বয়স বেশি তাদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের তীব্রতা কমানোর জন্য ডিম্বনালী এবং জরায়ু সার্জারি করে অপসারণ করা হয়।
উল্লেখ্য, আপনার যদি ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস ধরা পড়ে সে ক্ষেত্রে আপনাকে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হবে যা গর্ভকালীন সময়েও নিরাপদ। তবে অবশ্যই অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করতে হবে যদিও সংক্রমণের লক্ষণগুলো সেরে যায়। অন্যথায়,আবার যেকোন মুহূর্তে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। ৩০ ভাগ মহিলার ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস তিন মাসের মধ্যে আবার দেখা দেয়। অ্যান্টিবায়োটিক এর কাজ হল খারাপ ব্যাকটেরিয়াগুলো-কে মেরে ফেলা। কিন্তু এটি ভালো ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। পুনরায় লক্ষণ প্রকাশ পেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন। এর পাশাপাশি স্বামী বা পার্টনারের চিকিৎসাও জরুরি। অন্যথায় বার বার জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাবে।
সময়মতো চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তাঃ
যথাসময়ে জরায়ু ইনফেকশনের চিকিৎসা না করালে বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে দীর্ঘদিন ধরে তলপেট ব্যথা, কোমর ব্যথা, ডিম্বনালীর পথ বন্ধ হয়ে বা জরায়ু এবং এর আশপাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক অবস্থান নষ্ট হয়ে সন্তান ধারণে অক্ষমতা বা বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি ডিম্বনালীর পথ বাধাগ্রস্ত হয়ে একটোপিক প্রেগনেন্সিও (জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ) হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। প্রজননতন্ত্র সংক্রমণের যথাযথ চিকিৎসা না নিলে গর্ভপাত, সময়ের আগে বাচ্চা প্রসব এবং কম ওজনের বাচ্চা জন্মদানেরও ঝুঁকি বেড়ে যায়। আর গর্ভবতী নয় এমন মেয়েদের ক্ষেত্রে পেলভিক ইনফ্লেমেটরি ডিজিজ এর আশঙ্কা দেখা দেয়। এটি sexually transmitted disease (যেমন- গনোরিয়া, ক্লামাইডিয়া, HIV ইত্যাদি)-এ সংক্রমিত হওয়ার পথকে সুগম করে।
তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য সমস্যা। শুধু একটু সচেতনতা আপনাকে মারাত্মক জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে।
জরায়ু ইনফেকশনের হলে ঘরোয়া চিকিৎসা
এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান খুব উন্নত। তবে ডাক্তারি পরামর্শের পাশাপাশি আপনি ঘরোয়া কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
চলুন, দেখে নিই কি উপায়ে আপনি ঘরে বসেই সংক্রমণের মাত্রা হ্রাস করবেন-
দই ব্যবহারে:
দইয়ে Lactobacillus acidophilus নামে একধরনের ভাল ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। যেখানে খুব চুলকানি হচ্ছে বা সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে, ২০-৩০ মিনিট দই লাগিয়ে রাখুন। তারপর কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। সরাসরি যৌনাঙ্গেও দই লাগাতে পারেন। দিনে দু’বার লাগান। ঘণ্টা দুই রেখে ধুয়ে নিন। এটি আপনার শরীরকে যেকোনো ধরনের ইনফেকশন থেকে রক্ষা করবে।
নারকেল তেল:
নারকেল তেলে অ্যান্টিফানগাল উপকরণ থাকে যা ছত্রাককে ধরাশায়ী করতে খুবই কার্যকরী। সংক্রমণ এলাকায় (তবে যৌনাঙ্গের ভিতরে লাগাবেন না) ভালভাবে নারকেল তেল লাগান। দিনে ২ থেকে ৩ বার লাগালে দ্রুত কাজ হবে। সঙ্গে একটু দারুচিনি তেল মিশিয়ে নিলে সংক্রমণ ছড়ানোর আর ভয় থাকবে না।
অ্যাপল সিডার ভিনিগার:
হাল্কা গরম জলের সঙ্গে দুই টেবিল চামচ অ্যাপল সিডার ভিনিগার মিশিয়ে দিনে দু’বার করে সপ্তাহখানেক খান। সাদা ভিনিগার বা অ্যাপল সিডার ভিনিগার জলে মিশিয়ে সংক্রমণের জায়গায়ও লাগাতে পারেন। এতে ভালো কাজ হবে।
রসুন:
অ্যান্টিফাংগাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং ঘরোয়া অ্যান্টিবায়োটিক হিসাবে রসুনের জুড়ি নেই। কয়েক কোয়া রসুন নিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। যেসব জায়গায় ফুসকুড়ি হয়েছে বা জ্বলছে ঐ স্থানে কিছুক্ষণ লাগিয়ে রাখুন। পাশাপাশি রোজ এক কোয়া করে রসুন খেতে পারেন। ছত্রাক নিরাময়ে এটি বেশ উপকারি।
যতটা সম্ভব ঢিলেঢালা পোশাক পড়া দরকার। আর সংক্রমণের জায়গাটা সবসময় পরিষ্কার রাখবেন। প্রচুর পরিমাণে পানি খাবেন। দেখবেন দ্রুত সেরে উঠছেন ইনশা’আল্লাহ।
যেসব বিষয় মেনে চলা খুব জরুরি:
নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক এবং কনডম ব্যবহার জীবাণুর সংক্রমণ থেকে জরায়ুকে রক্ষা করে।
যত্রতত্র এম আর (গর্ভপাত) করানো থেকে বিরত থাকুন। বাংলাদেশে অনেক ফার্মেসির দোকানেও গর্ভপাত করানো হয়। যা কখনোই উচিৎ নয়। কারণ সেখানে জীবাণু সংক্রমণের পাশাপাশি মৃত্যু ঝুঁকিও থাকে। তাই গর্ভপাত বা ডিএন্ডসি করাতে হলে কোন ভালো গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গিয়ে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে গর্ভপাত করানো উচিৎ।
ধূমপানের অভ্যাস থাকলে এখনি তা ত্যাগ করার সময়। ধূমপায়ীদের রক্তে (নিকোটিনের) পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে সংক্রমণের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং জরায়ুর মুখে ক্যান্সার এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
হট টাব বা বাথ টাব এ গোসল না করে শাওয়ার নেয়ার চেষ্টা করুন। গোসলের পর যৌনাঙ্গ ভালোভাবে পরিষ্কার এবং শুষ্ক রাখতে হবে। সুগন্ধি ও রুক্ষ সাবান যথাসম্ভব পরিহার করুন।
বিশেষ অঙ্গের নিয়মিত যত্ন ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আপনাকে পরিছন্ন ও স্বাস্থ্যবান রাখবে। যত্ন নেয়া মানে শুধু গোসলের সময় পরিষ্কার করা নয়। নারীদের যৌনাঙ্গ প্রতিদিন তিন থেকে চারবার পরিষ্কার করা উচিৎ। বিশেষ করে বর্ষা ঋতু এবং পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে। এতে করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
সুতি কাপড় নরম এবং অধিক ত্বকবান্ধব। এটি দ্রুত আর্দ্রতা শুষে নেয় এবং বাতাস চলাচলের জন্য অধিক উপযোগী। বিশেষ কোনো উপলক্ষে সুতি কাপড়ের অন্তর্বাস পরতে পারেন। পাশাপাশি টাইট জামাকাপড় এড়িয়ে চলুন। কারণ এ ধরনের পোশাক বায়ু চলাচলে বাধা তৈরি করে।
Douche ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। গর্ভাবস্থায়ও Douche এর ব্যবহার উচিৎ নয়।
কোনো রকম ছোট সংক্রমণকে অবহেলা করা উচিৎ নয়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, যৌন-স্বাস্থ্য ভালো থাকা মানে শরীর ভালো থাকা। নির্বিঘ্ন সুরক্ষিত যৌনজীবন আনন্দময়।
Source:
https://www.medicalnewstoday.com/articles/321298
https://www.medicalnewstoday.com/articles/177923
https://www.webmd.com/women/guide/your-guide-urinary-tract-infections
https://www.webmd.com/women/guide/cervicitis
https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/urinary-tract-infection/symptoms-causes/syc-20353447
https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/pelvic-inflammatory-disease/symptoms-causes/syc-20352594
https://medlineplus.gov/ency/article/000888.htm
https://www.southerncross.co.nz/group/medical-library/urinary-tract-infections-symptoms-treatment-prevention