গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ
পিরিয়ড বন্ধ হওয়া গর্ভধারণের প্রাথমিক লক্ষণ। এছাড়া নিচের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে আপনি গর্ভবতী কিনা এটা পরীক্ষা করিয়ে নিন- তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিষেকের পর, একটি নতুন জীবনকে জায়গা দেওয়ার জন্য শরীর নিজেকে প্রস্তুত করে তোলে। এসময় শরীরের তাপমাত্রা অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। যদি টানা ১৮ দিন শরীরের তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকে তাহলে অবশ্যই প্রেগন্যান্সি টেস্ট করান। স্তনে ব্যথা অনুভব গর্ভধারণের পর ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে, গর্ভবতী মা স্তনে ব্যথা অনুভব করেন। এ সময় স্তনবৃন্ত গাঢ়তর দেখায় এবং স্তন অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। পুরো প্রেগন্যান্সির সময় জুড়েই স্তনের আকারে পরিবর্তন হয়ে থাকে। কখনো কখনো নিপল চেপে ধরলে এক ধরনের তরল বেরিয়ে আসে। অবসাদ এবং ক্লান্তি বাড়ন্ত শিশুকে পুষ্টি দেওয়ার জন্য গর্ভাবস্থায় শরীরে অতিরিক্ত রক্ত উৎপন্ন হয়। এজন্য এসময় অল্পতেই ক্লান্তি এসে যায়। প্রথম সপ্তাহে এই ক্লান্তিভাব সবচেয়ে বেশি হয়। বমি বমি ভাব প্রেগন্যান্সির শুরুর দিকে, আপনি অস্বস্তি এবং বমি বমি ভাব অনুভব করতে পারেন। বমিভাবের বিড়ম্বনা থেকে মুখে অতিরিক্ত তরল সৃষ্টি হয়। এর ফলে মুখ থেকে লালা পড়তে থাকে। বমির ঔষধ খাওয়ার চেয়ে ঘরোয়া উপায়ে বমি দূর করুন। গন্ধের প্রতি বিতৃষ্ণা গর্ভধারণের শুরুর দিকে আপনি মুখে অদ্ভুত বাজে স্বাদ অনুভব করতে পারেন। এসব উপসর্গ আপনাকে জানান দেয়, আপনি মাতৃত্বের পথে যাত্রা শুরু করেছেন। পেট ফোলা অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ এসময় পরিপাক কাজে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে অন্ত্রে গ্যাস আটকে থাকে। এতে পেট ফুলে অপ্রীতিকর বাতকর্ম এবং ঢেঁকুর হতে পারে। প্রস্রাব করার তাড়না শিশু যত বড় হয়, জরায়ুর আকারও তত বাড়ে এবং মূত্রথলির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়তে থাকে। ফলে ঘন ঘন প্রস্রাবের তাড়না দেখা দেয়। মুড সুইং গর্ভকালীন সময়ে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, যা মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে প্রভাবিত করে। এর ফলে কেউ কেউ বেশি উচ্ছ্বাসপ্রবণ হয়ে পড়েন আবার অনেকে ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন। মাথা ব্যথা গর্ভাবস্থায় রক্তবাহী নালীগুলো স্ফীত হয়ে যায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয়। ফলে মাথা ব্যাথার সৃষ্টি হয়। গর্ভাবস্থায় লিগামেন্ট এবং জয়েন্টের প্রসারণের ফলে মেরুদণ্ডেও ব্যথা হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রোজেস্টেরোন হরমোন নিঃসরণ কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য দায়ী। পিরিয়ড মিস করার পর এক সপ্তাহের বেশী সময় ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগলে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করুন।আরো পড়ুনঃ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার প্রাকৃতিক উপায়
শ্বাসকষ্ট দুটি জীবনের শ্বাস নেওয়ার জন্য, গর্ভাবস্থায় আপনার আরো বেশী অক্সিজেন এবং রক্তের প্রয়োজন হয়। তাই, এসময় আপনার শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় মুখে ব্রণ বা পিম্পলসও দেখা দেয়। উদ্ভট স্বপ্ন সাধারণত গর্ভে সন্তান এলে গর্ভবতী মায়েরা অতিরিক্ত পরিমাণে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। গর্ভবতী হয়েছেন এমন স্বপ্নই দেখেন তারা। এসময় তাদের দৃষ্টি বিভ্রমও হয়। খাবারে অরুচি শরীরে হরমোনের তারতম্যের কারণে এসময় খাবারে অরুচি সৃষ্টি হয়। রক্তপাত বা স্পটিং জরায়ুতে ভ্রূণ ইমপ্ল্যান্টেশনের সময় রক্তপাত হতে পারে। ওভুলেশনের এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে এ ইমপ্ল্যান্টেশন হয়ে থাকে। স্পটিং হওয়ার পরে বাড়িতে কিট এনে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে নিন। গর্ভাবস্থায় করণীয় শিশুর জন্মপূর্ব সময়ে (Pre-natal) মাল্টি-ভিটামিন খাওয়া শুরু করুন, খাদ্যাভাসের দিকে নজর দিন। অনেক মা মনে করেন ভিটামিন ওষুধ খেলে বাচ্চা বড় হয়ে যায় এবং সিজারের সম্ভাবনা বাড়ে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ভিটামিন মায়ের শরীরের রক্তশূন্যতা দূর করে এবং হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। ক্রনিক অসুখ (ব্লাড প্রেসার, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) থাকলে, তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে যত্নবান হোন।গর্ভাবস্থায় অন্যান্য করণীয় কাজ:
পরিমিত পরিমাণ পানি পান গর্ভাবস্থায় মহিলারা প্রায়শই ডিহাইড্রেটেড হয়ে যান। পর্যাপ্ত পরিমাণ পান পান করে, আপনি কেবল ডিহাইড্রেশনই প্রতিরোধ করছেন না, পাশাপাশি মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকিও হ্রাস করছেন। ডায়েট আপনার ডায়েটে ফলিক অ্যাসিড বাধ্যতামূলক করুন। ফলিক এসিড আপনার গর্ভের সন্তানের স্নায়ুর বিকাশে সাহায্য করে। খাওয়া এবং ব্যায়ামের মধ্যে একটি ভাল ভারসাম্য বজায় রাখুন। কেগেল ব্যায়াম করার জন্য নিয়মিত সময় দিন। কেগেল পেশী যোনি অঞ্চলে থাকে যা আপনাকে আপনার মূত্রত্যাগ এবং অন্যান্য গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এতে গর্ভকালীন ব্যথা থেকেও মুক্তি পাবেন। এসময় হালকা কাজ করলে ক্ষতি হবে না। তবে ভারী কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। ভ্রমণে সতর্কতা ভ্রমণ করার সময় খুব বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। অল্প দূরত্বের ভ্রমণ বা দূরের সফরে যাওয়া, যাই হোক না কেন, আপনার যাত্রা শুরু করার আগে আপনার কাছে প্রয়োজনীয় সমস্ত ওষুধ এবং গিয়ার রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করুন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম দুপুরে খাওয়ার পর ন্যাপ বা হালকা ঘুমিয়ে নিন। এতে আপনার শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় হবে।আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় অনিদ্রা দূর করার ১০টি ঘরোয়া উপায়
গর্ভাবস্থাকে স্মরণীয় করুন একটি ছোট ডায়েরি লেখা শুরু করুন। প্রতিদিন আপনি কি করেছেন এবং কেমন অনুভব করেছেন-তা লিখুন। ডাক্তারি পরামর্শ কোন ব্যথা বা যন্ত্রণা অথবা জ্বরের ক্ষেত্রে প্রথমে আপনার ডাক্তারকে যোগাযোগ করুন। চিকিৎসকের সাথে কথা বলার আগে কোন ওষুধ, এমনকি মলম বা লোশনও ব্যবহার করবেন না। বিশেষ রোগ-প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এ সময় নিয়মিত সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করুন এবং হাত-পায়ের নখ কেটে ছোট করে রাখুন। গর্ভকালে মায়েদের দাঁতগুলো বেশ নরম হয়ে যায়, তাই দাঁত ও মাড়ির বিশেষ যত্ন নিতে হবে। পিচ্ছিল স্থানে হাঁটা যাবে না এবং সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক, সহজে পরিধানযোগ্য ও ঢিলেঢালা পোশাক পরা উচিৎ। সঠিক মাপের এবং নরম জুতো পরুন। গর্ভাবস্থায় রক্তপাত এবং সমাধান রক্তপাত ঘটার পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে প্রথমে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। এর মাধ্যমে গর্ভস্থ সন্তান জীবিত নাকি মৃত সেটা জানা যাবে। জীবিত সন্তান গর্ভে থাকার পরও রক্তপাত হতে পারে, যাকে বলে ‘থ্রেটেন্ড মিসক্যারেজ’। এসব ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করা যায় এবং সুস্থ শিশু ভূমিষ্ঠ করা যায়। আল্ট্রাসনোগ্রাম ছাড়াও রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় গর্ভস্থ সন্তান সুস্থ রয়েছে কি না। অনেক সময় আঘাত বা পানি বেশি থাকার কারণে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল সময়ের আগেই জরায়ু থেকে সরে আসে। এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, যাকে ‘প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন’ বলা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে গর্ভফুল জরায়ুর মুখের ওপর বা জরায়ু মুখের খুব কাছাকাছি ইমপ্লান্টেড হয়ে থাকে। ওই সময় এসব রোগীকে হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সির রোগী হিসেবে শনাক্ত করে চিকিৎসা করা হয়। নিরাপদ ডেলিভারির জন্য আগে থেকে তিন থেকে চারজন রক্তদাতা রেডি করে রাখুন। গর্ভাবস্থায় রক্তপাত এড়াতে-:❏ গর্ভাবস্থায় পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
❏ ভারী কাজ করা যাবে না।
❏ দুশ্চিন্তামুক্ত ও সদা হাসিখুশি থাকতে হবে।
❏ তলপেটে আঘাত, চাপ লাগা বা এমন কোনো কাজ করা যাবে না।
❏ দূরবর্তী স্থানে বা ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ করা যাবে না।
❏ সহবাস থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
❏ থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, ইনফেকশন ইত্যাদি থাকলে তার চিকিৎসা নিতে হবে।
❏ নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
পা ফোলা প্রতিরোধে করণীয়: গর্ভাবস্থায় আপনার শরীর বাড়তি তরল তৈরি করে এবং কখনো কখনো আপনার পা এবং পায়ের পাতায় এই তরল জমা হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়৷ ফোলাভাবের উপশম করতে, দিনের বেলায় কিছুক্ষণ পা উপরদিকে তুলে রেখে বিশ্রাম করার চেষ্টা করুন৷ অনেকক্ষণ ধরে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ফোলাভাব বেড়ে যেতে পারে। তাই কিছু কিছু কাজ বসে করার চেষ্টা করুন৷ শুতে যাওয়ার এক ঘন্টা আগে থেকে কোনো তরল না খাওয়ার চেষ্টা করুন৷ হাঁটু দুটির মাঝখানে বালিশ বা কাপড়ের প্যাড রেখে বাঁ পাশ ফিরে ঘুমোন৷গর্ভবতী মায়ের টিকা
গর্ভাবস্থায় যে ৫ ধরণের টিকা নেয়া নিরাপদ : ১। ফ্লু(flu) এর টিকা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (CCD) ফ্লু(flu) এর ঋতুতে গর্ভবতী নারীদের ফ্লু শট নেয়ার পরামর্শ দেয়। গর্ভাবস্থায় ফ্লুতে আক্রান্ত হলে নিউমোনিয়ার মত জটিল অবস্থারও সৃষ্টি করতে পারে। ২। টিটেনাস/ডিপথেরিয়া/পারটুসিস টিকা(Tdap) টিটেনাস রোগের ঝুঁকি এড়াতে গর্ভবতী মহিলাদের টিটানাস টক্সয়েড ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ। Tdap গর্ভাবস্থার যে কোন সময়ই নেয়া যায়। তবে গর্ভকালের ২৭-৩৬ মাসের মধ্যে নেয়াটাই উপযুক্ত সময়। ৩। হেপাটাইটিস বি এর টিকা গর্ভবতী নারী যদি হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত হন, তাহলে ডেলিভারির সময় এই ইনফেকশন নবজাতকের মধ্যে ছড়াতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা করা না হলে শিশুর পরিণত বয়সে যকৃতের ক্রনিক রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। CCD এর মতে সকল গর্ভবতী নারীরই হেপাটাইটিস বি শনাক্তকরণের পরীক্ষা করানো উচিৎ। কারণ অনেকে লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। ৪। হেপাটাইটিস-এ এর টিকা পানি ও খাবারের মাধ্যমে হেপাটাইটিস-এ তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে জ্বর, ক্লান্তি ও বমি ভাব দেখা দেয়। হেপাটাইটিস-এ এর সংক্রমণ গর্ভের সন্তানের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ৫। নিউমোকক্কাল ভ্যাক্সিন ডায়াবেটিস অথবা কিডনি রোগে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কোন কোন টিকা গর্ভাবস্থায় নেওয়া যাবে না: কিছু টিকা রয়েছে, যা গর্ভকালীন সময়ে নেওয়া রীতিমতো বিপজ্জনক। মাম্পস, হাম, চিকেন পক্স, বিসিজি, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, টাইফয়েডের টিকা গর্ভাবস্থায় নেয়া থেকে বিরত থাকুন।গর্ভবতী মায়ের দৈনিক খাদ্য তালিকা
গর্ভাবস্থায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি ও ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ খাবার খান। আপনার গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্কের ও চোখের গঠনের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি। গর্ভের তৃতীয় ট্রাইমিস্টার বা ৭ম মাস থেকে ৯ মাস বা বাচ্চা জন্মানোর আগ পর্যন্ত সময়টাতে কোষ্ঠকাঠিন্য হবার বেশি আশঙ্কা থাকে। আদা চা গর্ভবতী মায়েদের এ কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দিতে দারুণ সহায়ক। হজমশক্তি বাড়াতে এর পাশাপাশি নিয়মিত আঁশযুক্ত ফল ও শাকসবজি খান।গর্ভবতী মহিলাদের কিছু স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকা-
ডিম ডিমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা গর্ভের শিশুর বৃদ্ধির জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। একটি ডিমে একশো বারো মিলিগ্রাম কোলাইন থাকে যা গর্ভের শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে। ফর্টিফায়েড ফুড হরমোনের পরিবর্তনের ফলে গর্ভাবস্থায় অপ্রত্যাশিত ক্ষুধার সৃষ্টি হয়। এ চাহিদা মেটানোর জন্য খাদ্যশস্য (গমবীজ, তেলবীজ, ভূট্টাদানা ইত্যাদি ) খুবই উপযোগী। কলা কলা ফোলিক এসিড, ভিটামিন বি ৬, ক্যালসিয়াম এবং পটাসিয়ামের ভালো উৎস। উপরন্তু, কলা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ এবং ইনস্ট্যান্ট শক্তিবৃদ্ধিকারী। পুষ্টি চাহিদা মেটাতে গর্ভাবস্থায় দিনে তিন থেকে চারটি কলা খান। মিষ্টি আলু মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ফোলিক এসিড, ভিটামিন সি এবং বিটা ক্যারোটিন বিদ্যমান থাকে। যা একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য প্রয়োজনীয়। মাছ গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ট্রাইমিস্টারে প্রচুর মাছ খাবেন, কারণ এটি আয়োডিনের চাহিদা মেটাতে খুব সহায়ক। এ সময়ে বাচ্চার থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কাজ করা শুরু করে। থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতার জন্য আয়োডিন অতীব প্রয়োজনীয় উপাদান। এটি প্রিক্ল্যাম্পসিয়ার মতো মারাত্মক জটিলতার বিরুদ্ধেও সুরক্ষা প্রদান করে। বাদামের মাখন কাজুবাদাম, নারকেল এবং ব্রেজিল বাদাম–এই সব থেকে একটি স্বাস্থ্যকর মাখন তৈরি করা যায়। গর্ভের শিশুর মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশের জন্য এ ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি অত্যন্ত উপকারি। বাদাম নিয়ে আরো পড়ুনঃ হরেক রকম বাদামে হরেক রকম স্বাদ। মটরশুটি মটরশুটিতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং ফাইবার রয়েছে। এতে বিদ্যমান উচ্চমাত্রার পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম গর্ভবতী মহিলাদের জন্য উপকারি। মটরশুঁটি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতেও দারুণ সহায়ক। এসময় গর্ভস্থ শিশুর দেহে লৌহের চাহিদা মেটানোর পর মায়ের রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ বা ক্লান্তি, বুক ধড়ফড় করা, মাথাঘোরা ইত্যাদি দেখা যায়। বাড়তি পুষ্টি চাহিদা মেটাতে কলিজা, কালো ও সবুজ কচুর শাক, বিট, লেটুসপাতা, হলুদ ইত্যাদি খান। খাদ্য গ্রহণে সতর্কতা- গর্ভাবস্থায় কাঁচা ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। কারণ এতে সালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে। অপাস্তুরিত দুধ বা কাঁচা দুধে লিস্টেরিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাই ভালো করে না ফুটিয়ে দুধ পান করবেন না। লিভারে রেটিনল থাকে; যা প্রাণীজ ভিটামিন-এ এর উৎস। তবে অতিরিক্ত কলিজার তৈরি খাবার গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কফি ক্লান্তি দূর করার জন্য কার্যকর হলেও গর্ভাবস্থায় কফি খাওয়া যথাসম্ভব পরিহার করুন। অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম গ্রহণ করে। মিসক্যারেজের মত ঘটনাও ঘটতে পারে। সামুদ্রিক মাছ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি। কিন্তু অধিক পরিমাণে খেলে গর্ভের শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। কারণ সামুদ্রিক মাছে পারদ জাতীয় পদার্থ থাকে। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য কাঁচা বা আধা পাকা পেঁপে খাওয়া বিপদজনক। এতে গর্ভপাতের আশঙ্কা রয়েছে।গর্ভবতী মায়ের ওজন
মায়ের স্বাস্থ্যকর ওজন—মা আর শিশু দুজনের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মায়ের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম হলে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়, শিশুর ওজন কম হয়। এ ছাড়া গর্ভকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই সন্তানের জন্ম হয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে মায়ের ওজন কম থাকলে। কম ওজন নিয়ে কিংবা পূর্ণ গর্ভকাল পেরোনোর আগে জন্মানো শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে কম হয়। নানান জটিলতায় ভোগে এই শিশুরা। অন্যদিকে মায়ের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বেড়ে গেলে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতা বাড়ে। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-একলাম্পসিয়া, একলাম্পসিয়া ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। গর্ভস্থ শিশু অত্যধিক বড় হয়ে যেতে পারে, প্রসবের সময় শিশু বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে (অবস্ট্রাক্টেড লেবার), প্রসব হতে খুব বেশি সময় লাগতে পারে (প্রলম্বিত প্রসব)। প্রসবের সময় শিশুর মাথা বের হয়ে ঘাড় আটকে যেতে পারে, এমনকি প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। ওজন বাড়তি থাকলে প্রসব–পরবর্তী সময়ে মায়ের অত্যধিক রক্তক্ষরণ হতে পারে, যা মাকেও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের মাসে এক কেজি বা প্রতি দুই সপ্তাহে আধা কেজি ওজন বাড়া সুস্থতার লক্ষণ। গর্ভের শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে মায়ের বাড়তি এনার্জির প্রয়োজন। তাই গর্ভাবস্থার তৃতীয় ট্রাইমিস্টারে এসে আপনি বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাবেন। তবে অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি হয়ে থাকলে ওজনে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করুন।গর্ভবতী মায়ের ঘুমানোর নিয়ম
চিকিৎসকরা গর্ভবতী নারীদের বাম পাশ ফিরে ঘুমাতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কেন? গর্ভকালে ভ্রুণ দিনদিন বড় হতে থাকে, তাই এটি স্বাভাবিকভাবেই তার মায়ের অভ্যন্তরীণ অর্গান ও রক্তনালীতে ক্রমান্বয়ে বেশি চাপ ফেলে। শিশু যখন ব্লাডারে অথবা অন্ত্রে লাথি মারে, তখন গর্ভবতী মা ব্যথা অনুভব করতে পারেন। এজন্য বাম পাশ ফিরে শোয়াই সব থেকে বেশি নিরাপদ। এতে রক্ত সঞ্চালন সহজতর হয়, গর্ভের শিশুর পুষ্টি জোগাতে আপনার হার্ট থেকে অমরা/গর্ভফুলে রক্ত সরবরাহের জন্য সহজ পথ তৈরি হয়। এভাবে শোয়াতে আপনার লিভার, অতিরিক্ত ওজনবিশিষ্ট শরীরের চাপ থেকে সুরক্ষিত থাকবে। গর্ভাবস্থায় চিৎ বা উপুড় হয়ে শোবেন না। যখন উপুড় হয়ে শোবেন পাকস্থলী তখন আপনার প্রসারিত জরায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করবে। আপনি যদি চিত হয়ে ঘুমান তাহলে হয়তো আপনার নিঃশ্বাস নিতে বেশি কষ্ট হবে।নিরাপদ গর্ভধারণে আরো কিছু টিপস্-
পেট ও পিঠকে একটু বেশি সাপোর্ট দিতে দুই হাঁটুর মাঝে একটি বালিশ ব্যবহার করুন। শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পেতে আপনার বুকের পাশেও একটি বালিশ আলতো করে রাখতে পারেন। এতে আপনার পাকস্থলী এসিডিটি থেকে মুক্ত থাকবে আর আপনার হার্ট এ জ্বালাপোড়াও কম অনুভব হবে। এ কৌশল অবলম্বন করলে ঘুমন্ত অবস্থায় আপনার বডি আপনা-আপনিই আরামদায়ক পজিশনে থাকবে নতুবা আপনাকে জাগিয়ে দেবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমোনো আপনার জন্য এখন খুব জরুরি। গর্ভাবস্থায় দিনের বেলা কমপক্ষে দু-ঘণ্টা ঘুম বা বিশ্রাম এবং রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। ঘুমের অভাবে আপনার প্রি-এক্লাম্পসিয়া বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এটি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং পালমোনারি হাইপারটেনশনেরও আশঙ্কা তৈরি করে।গর্ভবতী মায়ের আ’মল
ভ্রুণ অবস্থা থেকে মায়ের যাবতীয় আমল ও আখলাক গর্ভে থাকা সন্তানের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে, গোনাহ ও আল্লাহর নাফরমানি থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এ সময়ে পরনিন্দা-পরচর্চা করা, ঝগড়া করা, গালা-গালি করা ও অন্যান্য মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা বাঞ্চনীয়। এছাড়া করণীয়- ১. অসুস্থতা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে ধৈর্যহারা হবেন না। ‘এই সময়টার প্রতিটি মুহূর্ত আপনার জন্য জিহাদতূল্য ইবাদত’। নবীজী ﷺ চমৎকার বলেছেন, الصَّبْرُ ضِيَاءٌ সবর হল জ্যোতি। (মুসলিম: ২২৩) ২. যখনি মা হওয়ার আনন্দে পুলকিত হবেন তখনি আল্লাহর শোকর আদায় করুন। আল্লাহ তাআলা বলেন, واشكروا لي ولا تكفرون আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সূরা বাকারা: ১৫২) ৩. ওযু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করুন: কেননা দৈহিক সুস্থতা ও আত্মিক প্রশান্তির ক্ষেত্রে ওযুর ভূমিকা অপরিসীম। ৪. এসময় বেশি বেশি কুর’আন তিল’ওয়াত করুন। প্রায় ২০ তম সপ্তাহে গর্ভের বাচ্চা শোনার সক্ষমতা অর্জন করে। মা প্রতিদিন কিছু কুর’আন তিল’লওয়াত করে বাচ্চার মাঝে কুর’আনের মাঝে সম্পর্ক জুড়ে দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। বুযুর্গগণ কতিপয় সূরার বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ রেখে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন—☞ প্রথম মাসে সূরা-আল ইমরান পড়লে সন্তান দামি হবে। ☞ দ্বিতীয় মাসে সূরা-ইউসুফ পড়লে সন্তান সুন্দর হবে। ☞ তৃতীয় মাসে সূরা মারিয়াম পড়লে সন্তান সহিষ্ণু হবে। ☞ চতুর্থ মাসে সূরা-লোকমান পড়লে সন্তান বুদ্ধিমান হবে। ☞ পঞ্চম মাসে সূরা-মুহাম্মদ পড়লে সন্তান চরিত্রবান হবে। ☞ ষষ্ঠ মাসে সূরা-ইয়াসিন পড়লে সন্তান জ্ঞানী হবে। ☞ সপ্তম, অষ্ঠম, নবম ও দ্বশম মাসে সূরা-ইউসুফ, মুহাম্মদ এবং ইব্রারাহিম কিছু কিছু পড়বে।
☞ ব্যাথা উঠলে সূরা-ইনশিকাক পড়ে পানিতে ফুক দিয়ে পান করলে ব্যথা কমে যাবে।
৫. গর্ভকালীন সময়ে মাঝে মাঝে অসহায়বোধ হয়। এমনও মনে হয়, না-জানি এবার আমি মরে যাব কিনা! তাই গর্ভকালীন সময়ে বেশি বেশি দু’আ করুন। কেননা এ সময়ের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ বলেন, أَمَّن يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ বলো তো কে নিঃসহায়ের ডাকে সাড়া দেন, যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন? (সূরা নামল ৬২) ৬. নেক, সুস্থ ও সুন্দর সন্তান কামনা করে বার বার মহান রব্বুল আ’লামিনের কাছে প্রার্থনা করুন। যেমন, এ দোয়াটি মুখস্থ করে নিতে পারেন— رَبِّ هَبْ لِىْ مِنْ لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةًۚ اِنَّكَ سَمِيْعُ الدُّعَآءِ হে আমার পালনকর্তা! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পুত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী। (আল ‘ইমরান: ৩৮) ৭. আল্লাহর এ দু’টি গুণবাচক নাম পড়ুন: কোনো গর্ভবর্তী মহিলা যদি আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম (اَلْمُتَعَالِىْ) ‘আল-মুতাআ’লি’ এবং (اَلْمُبْدِئُ) ‘আল-মুবদিয়ু’ পড়তে থাকে তবে ওই মহিলা তার গর্ভকালীন কষ্টক্লেশ থেকে মুক্তি পায়।