এই ধরণী মাঝে নতুন শিশুর আগমন সৃষ্টিকর্তার পরম অনুগ্রহ। ক্ষুদ্র একটি ভ্রুণ তিল তিল করে মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে। তারপর একদিন আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ। শিশুর জন্মে পরিবার-পরিজনদের মাঝে আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। নতুন অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য চারদিকে চলে নানা আয়োজন। তাকে ঘিরে তৈরি হয় অনেক স্বপ্ন, সম্ভাবনা। তাই সদ্যভূমিষ্ঠ এই নবজাত শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য থাকতে হবে বাড়তি সতর্কতা এবং এর পাশাপাশি বিশেষ যত্ন নেওয়াও চাই।
নবজাতকের বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন কেন?
মূলত মাতৃগর্ভ আর পৃথিবীর মাঝে বিস্তর ফারাক। তাই নতুন এই পারিপার্শ্বিক অবস্থায় শিশুর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
জন্মের সময় নবজাতকের পাকস্থলী, কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদি পরিপূর্ণ থাকে না। এছাড়া তার ত্বকও অনেক সংবেদনশীল হয়। পৃথিবীর আলো- বাতাসের সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে তাকে অনেক কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়। তাই তার বেড়ে ওঠার এই পরিবেশকে অনুকূল করে তুলতে তার প্রতি আমাদের সযত্ন দৃষ্টি রাখা খুব প্রয়োজন।
জন্মপরবর্তী ঘণ্টার বিশেষ যত্ন:
শিশুর জন্মের প্রথম ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়কে তাই বলা হয় গোল্ডেন ওয়ান আওয়ার কেয়ার। নিউমোনিয়া ও ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে জন্মের সাথে সাথে শিশুকে শুকনো নরম কাপড় দিয়ে আলতো চাপ দিয়ে মুছে নিন।
এরপর আরেকটি পরিষ্কার শুকনো কাপড়ে মাথা ও শরীর জড়িয়ে রাখুন। দেরি না করে নবজাতককে মায়ের বুকে দিন। মায়ের শরীরের উষ্ণতা তার জন্য খুব প্রয়োজন। জন্মের ৩ দিনের মধ্যে কোনোভাবেই শিশুকে গোসল করানো যাবে না । এইসময়ের মধ্যে শিশুকে মায়ের শাল-দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মূলত শিশুর জন্মের পরপর মায়ের শরীরে প্রথম ঘন আঠালো হলুদ বর্ণের যে দুধ বের হয় এটিই তার একমাত্র খাবার।
শালদুধের উপকারিতা:
শালদুধ শিশুর জন্য প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে এবং শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি এটি নবজাতকের শরীরে পরিপূর্ণ পুষ্টি যোগায় । শালদুধ খাওয়ালে শিশুর রাতকানা, জন্ডিস ও অন্যান্য রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে । শালদুধ খাওয়ানো মা ও শিশু উভয়ের জন্যই জরুরি। কারণ শিশুকে শালদুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে মায়ের প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ কম হয় এবং জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে । তাছাড়া শিশুর সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ৬ মাস শুধু মায়ের বুকের দুধই খাওয়াতে হবে। এসময় এক ফোঁটা পানি খাওয়ানোরও প্রয়োজন নেই।
ঋতু অনুযায়ী নবজাতকের যত্ন
নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়কাল অনুযায়ী তার যত্নের ব্যবস্থা করতে হবে। একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে, যে প্রতিটা নবজাতকই আলাদা। এসময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নবজাতকের জন্য সঠিক পরিচর্যা নিতে হবে।
নবজাতক শিশুর গরমকালের যত্ন:
এসময় একটু পর পর বাচ্চার গায়ে হাত দিয়ে দেখতে হবে ঘাম আছে কিনা। বাচ্চাকে বেশি কাঁথা- কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা যাবে না। গরমের কারণে বাচ্চার গলা শুকিয়ে যেতে পারে। তাই বার বার মায়ের দুধ পান করানোর কোনো বিকল্প নেই।
এর পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন:
- শিশুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত নরম সূতি কাপড় ভিজিয়ে শিশুর গা মুছে দিতে হবে।
- গরমের সময় শিশুর দেহের বিভিন্ন জায়গায় ঘামাচি হতে পারে। ঘামাচি এড়ানোর জন্য নবজাতকের গোসলের পানি কুসুম গরম করে নিতে হবে।
- প্রয়োজন ছাড়া শিশুকে ডায়াপার না পরানোই ভালো।
- গরমের সময় নবজাতক শিশুর ঘুমাতে সমস্যা হয়। তাই ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করা খুব জরুরি। শিশুকে যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় রাখতে হবে।
- তাছাড়া বাড়ির আশে-পাশে কোথাও জলাবদ্ধতা থাকলে সে স্থান পরিষ্কার করে নিন। ফলে মশা জন্মাতে পারবে না। এবং বাড়ির জানালায় নেট লাগিয়ে রাখলে পোকামাকড়-মশা ইত্যাদির কামড় থেকে শিশু রক্ষা পায়।
নবজাতকের শীতকালীন যত্ন:
ঠাণ্ডা নবজাতক-কে খুব খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ থেকে বাচ্চার নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এসময় নবজাতকের মা ও অন্য যারাই বাচ্চার দেখাশোনা করবেন তাদের বারবার হাত ধুয়ে নিতে হবে। এতে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়।
শীতকালে খেয়াল রাখতে হবে নবজাতকের ঘরে যাতে ঠাণ্ডা বাতাস না আসতে পারে। ঘর যথাসম্ভব গরম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে দিনের বেলা দরজা-জানালা খোলা রেখে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুর ব্যবহার্য লেপ, তোশক, কম্বল, চাদর ইত্যাদি কড়া রোদে শুকাতে হবে। রোদ থেকে তোলার পর তা ভালো ভাবে ঝেড়ে পরিস্কার করাও জরুরি। এগুলোর ওপর কাপড়ের কভার ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো কারণ এতে সহজে ধুলাবালি থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া যায়।
পাশাপাশি শিশুর শরীরে রোদ লাগাতে হবে। এটি ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ করে এবং হাড়ও শক্ত করে। এসময় কোনো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন এবং ডাক্তারের পরামর্শমত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
পাশাপাশি লক্ষণীয়:
- শিশুকে কয়েক স্তরের শীতের কাপড় পরিধান করাতে হবে। তবে অতিরিক্ত মোটা পোশাক যেন শিশুর অস্বস্তির কারণ না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
- শিশুকে গরম রাখার জন্য কখনোই চুলার কাছে কিংবা আগুনের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। এর ফলে শিশুর শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি হতে পারে।
- খুব প্রয়োজন না হলে শিশুকে গোসল করানো থেকে বিরত রাখা উচিত।
- নবজাতককে উষ্ণ রাখার জন্য ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি অর্থাৎ মায়ের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে হবে।
- শিশুর দেহের তাপমাত্রার দিকে নজর রাখতে হবে। নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৫.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কম হলে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে৷ আবার তাপমাত্রা ৩৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৯.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের থেকে বেশি হলে নবজাতকের জ্বর হতে পারে। কোনো রকম অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হলে অবশ্যই অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
- নবজাতককে ঘন ঘন মায়ের বুকের দুধ খেতে দিন। বুকের দুধে রোগ প্রতিরোধক শক্তি থাকে বলে শিশু সহজে ঠাণ্ডা, কাশি ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয় না। সাথে সাথে মাকে অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। শিশু যদি ২৪ ঘণ্টায় ছয়বার প্রস্রাব করে তাহলে বুঝতে হবে ঠিকমতো দুধ পাচ্ছে। এছাড়া শীতে শুষ্ক আবহাওয়ায় ধুলোবালি বেশি থাকে। তাই খেয়াল রাখতে হবে শিশুর গায়ে যেন ধুলোবালি না লাগে।
নবজাতক শিশুর যত্ন ও পরিচর্যা:
প্রথমবার নবজাতককে স্পর্শ করার অনুভূতি তুলনাহীন। আবার এই আনন্দ-উদ্দীপনার মাঝেও মিশে থাকে খানিকটা স্নায়ুচাপ, আত্নপ্রত্যয়ের অভাব। তাই, দেখে নিই আপনি কিভাবে জন্মপরবর্তী সময়ে আপনার কলিজার টুকরা শিশুর লালন-পালন করবেন-
আরামদায়ক পোশাক পরান :
নবজাতককে গরম কিন্তু আরামদায়ক পোশাক পরিয়ে রাখতে হবে। নবজাতকের গায়ে ভারি কম্বল বা লেপ কোনোটাই দেওয়া যাবে না। শীতের প্রকোপ কমাতে নবজাতকের হাত ও পায়ে মোজা পরিয়ে রাখতে হবে। আপনার শিশুর গায়ের পোশাকটি তার অনুভূতি এবং ব্যবহারের উপর প্রভাব ফেলে। আরামদায়ক গরম পোশাক আপনার বাবুকে ভালোভাবে ঘুমাতে সাহায্য করবে। তবে ভারী এবং আঁটসাঁট কাপড় ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
নবজাতকের চোখের যত্ন:
চোখ অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশ। আঙুল, শাড়ির আঁচল, গামছা বা অপরিষ্কার কাপড় দিয়ে কখনোই নবজাতকের চোখ মোছা উচিৎ নয়। সব সময় পরিষ্কার, নরম সুতি কাপড় দিয়ে চোখ পরিষ্কার করতে হবে।
নবজাতকের ত্বকের যত্ন:
শিশুর ত্বককে সবসময় মসৃণ রাখতে হবে। এজন্য ভালো মানের বেবি লোশন বা ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। জন্মের পর শিশুর ত্বকের অবস্থা কিছুটা নাজুক থাকে। নবজাতকের ত্বকে ভারনিক্স (Vernix) নামের একপ্রকার তৈলাক্ত পদার্থ থাকে যা এন্টিবডির (Antibody) মতো কাজ করে। তাই শিশুর ত্বকের যত্নে হঠাৎ করেই কোনো পাউডার, ক্রিম, তেল ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
নাভির বিশেষ যত্ন:
নবজাতকের নাভির সংক্রমণের বেশ কয়েকটি লক্ষণ দেখা দিতে পারে; যেমন- নাভি থেকে পুঁজ পড়া, নাভির চারদিকে চামড়া পর্যন্ত লাল হয়ে যাওয়া, নাভিতে দুর্গন্ধ, নাভি দেরিতে পড়া ইত্যাদি। অনেক সময় নাভী থেকে এটি লিভারে গিয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পরতে পারে তখন জন্ডিস, লিভারের ফোড়া-সহ ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। কখনো কখনো এ ইনফেকশন হাড় অথবা অন্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পরতে পারে। এহেন পরিস্থিতিতে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নাভির সংক্রমণের চিকিৎসায় বিলম্ব হলে অথবা সঠিক চিকিৎসা না হলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
তবে জন্মের পরপরই নাভীর যত্ন নিলে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এসব লক্ষণ অল্পমাত্রায় দেখা দিলে নাভী স্পিরিট দিয়ে ঘন ঘন পরিষ্কার করতে হবে। সেই সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক পাউডার প্রয়োগ করতে হবে। তবে নাভীতে তেল বা এমন কোনো কিছু লাগানো যাবে না।
চুলের যত্ন:
চুল কাটার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর যেহেতু এটি শীতকালে ঠান্ডার প্রকোপ থেকে শিশুকে সুরক্ষা দেয়, তাই এসময় চুল না কাটাই ভালো। তবে ফাঙ্গাস, অ্যালার্জি বা অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মাথায় খুশকি বা মাথার চামড়া উঠে যেতে পারে। তখন চিকিৎসকের পরামর্শমতো ব্যবস্থা নিতে হবে। তেল বা শ্যাম্পু ব্যবহারের আগেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো।
গোসলের ক্ষেত্রে যেসব সাবধানতা জরুরি:
নবজাতকের গোসল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে জন্মের পরপরই তাকে গোসল দেয়া যাবে না। এত দিন মায়ের গর্ভে শিশু উষ্ণতার ভেতর ছিল। বাইরের বাতাসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তার একটু সময় লাগে। তাই জন্মের সাথে সাথে গোসল না করিয়ে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর গোসল করাতে হবে।
গোসলের পানিতে স্যাভলন বা ডেটল এসব দেওয়ার দরকার নেই। কুসুম গরম পানি দিয়ে যে ঘরে বাতাস নেই এ রকম জায়গায় গোসল করাতে হবে। জন্মের ৩ দিন পর থেকে শিশুকে প্রতিদিন গোসল বা গা মুছিয়ে দিয়ে হবে। শীতের সময়ে একদিন পরপর গোসল করানো ভালো। তাছাড়া শিশুর মাথা ভেজানোর পরে খুব দ্রুত ভালো করে মুছে ফেলতে হবে।
বার্থ এসফেক্সিয়া (Birth asphyxia):
নবজাতক জন্মের পর যদি নিজে নিজে নিঃশ্বাস নিতে ব্যর্থ হয়, তবে তাকে বার্থ এসফেক্সিয়া বা এসফেক্সিয়া নিউনেটারাম বলে। গর্ভাবস্থায় যদি মায়ের নিউমোনিয়া, হার্ট ফেইলুর, রক্তস্রাব বা এক্লামপসিয়া (Ecclampsia) জাতীয় কোনো রোগ থাকে তাহলে শিশুর এসফেক্সিয়া নিউনেটারাম হতে পারে। এছাড়া প্রসবের সময় শিশুর গলায় অনেক্ষণ নাড়ীর প্যাচ লেগে থাকা, মাথায় রক্তপাত হওয়া বা আঘাত পাওয়া কিংবা কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও এমন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
এক্ষেত্রে নবজাতক বিশেষজ্ঞ বা নিউন্যাটোলজিস্ট (Neonatologist)-এর পরামর্শ নিতে হবে। শিশু জন্মের ১ মিনিট এর মধ্যে ও যদি শ্বাস না নেয় তাহলে দ্রুত তার মুখ গহ্বর পরিষ্কার করে মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে হবে। এবং শিশুকে অতি দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে শিশুর তাপমাত্রা কোনোভাবেই কমে না যায়। এজন্য তাকে উষ্ণ কাপড়ে মুড়ে রাখতে হবে।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে সাকশন (suction) দিয়ে মুখ ও পেট খালি করা হয় এবং ৮০% অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়। জন্মের তিন মিনিটের মধ্যেও শ্বাস না নিলে মুখে বা গলায় নল দিয়ে কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাস দিতে হয়। সেই সাথে হাতের তালু দিয়ে বুকে ঘন ঘন চাপ দিয়ে (Cardiac massage) হৃদপিণ্ড সচল রাখতে হয়।
বার্থ এসফেক্সিয়া তীব্র হলে বা চিকিৎসা করাতে সামান্য দেরী হয়ে গেলেও শিশু মানসিক প্রতিবন্ধকতা, মৃগী রোগ, নির্জীব থাকা বা প্যারালাইসিস(Cerebral palsy)-সহ নানা জটিলতায় ভুগতে পারে। এ রোগে শিশুর মৃত্যুর হারও অত্যাধিক।
নবজাতকের ওজনহীনতা:
চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, কিশোরী মাতার সন্তানের ওজন সাধারণত খুব কম হয়। আবার গর্ভে শিশু পরিণত বয়সপ্রাপ্ত হবার আগে (Preterm) ভূমিষ্ঠ হলেও ওজন খুব কম হয়। এছাড়া গর্ভাবস্থায় মায়ের যদি ডায়াবেটিস (Diabetes), হৃদরোগ, কিডনি রোগ, পুষ্টিহীনতা, রক্তশুন্যতা, বড় কোনো ইনফেকশন, টক্সেমিয়া (Toxaemia), রক্তস্রাব বা এইধরনের জটিল কোনো রোগ থাকে তাহলে নবজাতকের ওজন কম হতে পারে। জমজ শিশু বা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুদের ওজন কম হয়। ধুমপায়ী মায়েদের সন্তানেরও জন্মের সময় ওজন বেশ কম থাকে।
কম ওজনের নবজাতক অল্পতেই যে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যেমন, অনেক সময় দেখা যায়, শিশুর মুখ ও নাকে শ্লেষ্মা এবং অন্যান্য পদার্থ জমে শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধার সৃষ্টি করে। সর্দি জমে থাকার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়। যার কারণে বুক ঘন ঘন ওঠানামা করে ও শিশু ক্লান্ত হয়ে পরে। এসকল লক্ষণ প্রকাশ পেলে সাথে সাথে মুখের লালা ও নাকের সর্দি পরিষ্কার করে দিতে হবে।
শিশুর ওজন একদমই কম হলে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে শিশু বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। পর্যাপ্ত পুষ্টির জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি নাকে নল দিয়ে খাবার দেয়া, এমনকি শিরার মাধ্যমেও খাবার দেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। শিশুর শরীরের তাপমাত্রা কমে গেলে তাকে ইনকিউবেটর (Incubator)-এ রাখতে হবে। ইনফেকশন প্রতিরোধ করার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি ভিটামিন এবং ফেনোবারবিটোন (Phenobarbitone)জাতীয় ঔষধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ভূমিষ্ঠ হওয়া (Preterm) শিশুর অবস্থা খুব খারাপ হলে শিশুকে এন,আই,সি,ইউ (NICU – Neonatal Intensive Care Unit)-তে ভর্তি করে চিকিৎসা করাতে হয়।
নবজাতকের পরিপূর্ণ যত্নে যা একান্ত জরুরি:
বুকের দুধ পানে:
শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর সময় মা পিঠ সোজা রেখে বসবেন। শিশুর পেট মায়ের পেটের সঙ্গে লাগানো রাখতে হবে। শিশু বড় হাঁ করে স্তনের বোঁটা নিয়ে নেবে। সিগারেট ধরার ভঙ্গিতে স্তনের বোঁটা শিশুর মুখে গুঁজে দেয়া ভুল।
আবার খেয়াল রাখতে হবে, যেন নবজাতকের পেটে গ্যাস জমে না যায়। এজন্য প্রতিবার খাবার পরে তাকে কাঁধের উপর শুইয়ে পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে ঢেকুঁর তোলাতে হবে। এতে পেটে গ্যাস জমে থাকলে এটি বেরিয়ে আসবে।
শিশুকে শোয়ানো:
বেশি তুলতুলে নরম বিছানায় নবজাতক শিশুকে শোয়ানো উচিৎ নয়। এতে করে সে উল্টে গিয়ে তার নাক-মুখ চেপে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিছুটা শক্ত বিছানা ও দুই পাশে ছোট বালিশ ব্যবহার করুন।
ঘুম থেকে জাগানো:
শিশুকে জাগাতে তীব্র কোনো বাজনা বাজানো বা শব্দ সৃষ্টি না করা ভালো। তাকে আলতোভাবে চুম্বন-স্পর্শ দিন। গায়ে হালকা করে সুড়সুড়ি দিন। আস্তে আস্তে সে জেগে উঠবে। পিঠে বা শরীরের অন্য অংশে জোরে থাপড় বা ঝাঁকুনি দেওয়া একদমই অনুচিৎ।
শিশুকে নিয়ে খেলার সময়:
ছোট্ট শিশুকে নিয়ে খেলার সময় ওকে এমনভাবে দুই হাতে ধরে রাখতে হবে, যেন সে হাত থেকে ছিটকে না পড়ে। হাত ছেড়ে শূন্যে খেলা করা মারাত্মক বিপদের কারণ হতে পারে।
শিশুকে শান্ত করানো:
হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে তার কান্না থামাতে যাওয়া অনুচিৎ। এগুলোর মধ্যে বিপজ্জনক দ্রব্যও থাকতে পারে। বরং তাকে কাঁধে নিন। মায়া-মমতায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিন। দেখবেন শিশুর কান্না থেমে যাবে।
শিশুকে হাসাতে:
অনেকে শিশুকে হাসানোর জন্য তার মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দেন। এটা একদমই নির্বোধের মতো কাজ। বরং তার বয়স অনুযায়ী রং-বেরঙের পুতুল নিয়ে তার সঙ্গে মজা করুন।
শিশুর নাক পরিষ্কার রাখতে:
নবজাতকের নাক পরিষ্কার করতে গিয়ে কেউ কেউ নিজের অপরিচ্ছন্ন আঙুলের ডগা শিশুর নাসারন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেন। এতে মারাত্মক সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। এক্ষেত্রে একটা পরিষ্কার কাপড় সুঁচোমুখ করে তাতে কয়েক ফোঁটা লবণমিশ্রিত পান দিয়ে শিশুর নাক পরিষ্কার করুন। প্রয়োজনে ন্যাজেল অ্যাসপিরেটরের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
দেহের উষ্ণতা:
উষ্ণ ও আরামদায়ক পরিবেশ আপনার শিশুকে সবসময় হাসিখুশি রাখবে। এজন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। যেসব দরজা-জানালা দিয়ে বাবুর ঘরে জোরে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকতে পারে সেগুলো বন্ধ রাখুন। কিন্তু স্বাভাবিক আলো-বাতাস চলাচলের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখুন। একইসাথে শুষ্কতা এবং ত্বক ফেটে যাওয়া এড়াতে পর্যাপ্ত আর্দ্র পরিবেশ বজায় রাখুন।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা একান্ত জরুরি:
নবজাতকের কাঁথা, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে তার ব্যবহৃত সবকিছু পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে। তাছাড়া শীতকালে ফ্লু ও ঠাণ্ডা লাগার বাড়তি ঝুঁকি থাকে। এজন্য শিশুকে খাওয়ানোর আগে, কোলে নেয়ার আগে এমনকি আদর করার সময় সংক্রমণ এড়াতে ভালো করে হাত ধুয়ে নিন অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। এতে আপনার বাবু ঝুঁকিমুক্ত থাকবে।
আবার শিশুর ব্যবহৃত কাপড় থেকে বিভিন্ন চর্মরোগের সৃষ্টি হতে পারে। তাই নিয়মিত কাপড় পরিষ্কার করতে হবে। আবার শিশুদের নখ বড় থাকার কারণে নখের আঁচড়ে দেহের বিভিন্ন জায়গায় চামড়া ছিলে যেতে পারে। এজন্য নবজাতকের নখ বড় হলেই কেটে ছোট করে দিতে হবে।
ম্যাসাজিং কিভাবে করবেন?
নবজাতক শিশুকে ম্যাসাজ করতে হবে। এতে তার শরীরের রক্ত-সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে। তেল এবং ময়েসচারাইজার শিশুকে রাখবে নরম এবং প্রাণবন্ত। তবে এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শমত একটি বা দু’টি ওয়েল বেছে নিন।
সতর্কতা:
কোন কারণে শিশু অসুস্থ হয়ে গেলেও মায়ের বুকের দুধ দেয়া বন্ধ করা যাবে না। আবার নবজাতক যাতে কোন অবস্থায় প্রস্রাব-পায়খানা করে তার মধ্যে বেশিক্ষণ না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সম্ভব হলে ডায়াপার পরাতে হবে। তবে ডায়াপার র্যাশ থেকে সাবধান হতে হবে। দিনের কিছু সময় ডায়াপার ছাড়া রাখতে হবে। তবে ডায়াপার র্যাশ যদি একান্ত হয়েই যায় সেক্ষেত্রে র্যাশ দূর করার ক্রিম লাগাতে হবে। পাশাপাশি নবজাতকের নাভি না পরা পর্যন্ত তেল বা পানি যাতে না লাগে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা:
সময় অনুযায়ী শিশুকে সবগুলো টিকা দেওয়াতে হবে। এটি শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অনেক বড় ভূমিকা রাখে এবং বেশ কিছু সংক্রামক অসুখের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। যদি কোনো কারণে একটি ডোজ বাদ যায়, তবে দ্রুত শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন এবং সেই অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা নিন।
যেসব কাজ একদমই করা যাবে না:
- শিশুর জন্মের পর অনেকেই মুখে মধু বা চিনি দিয়ে থাকেন। এটা মোটেই উচিৎ নয়। জন্মের ছয় মাসের মধ্যে শিশুকে মায়ের বুকের দুধের বাইরে কোনো কিছু খাওয়ানো তার জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।
- বাচ্চার গরম লাগবে ভেবে বাচ্চাকে একদম খোলা রাখা বা শীত লাগবে ভেবে বেশি কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা উভয়ই বর্জনীয়। এক্ষেত্রে বাচ্চাকে সহনীয় পোশাক পরাতে হবে।
- হলদেটে রঙ বিধায় অনেকে শাল দুধ খাওয়াতে নিরুৎসাহিত করেন। এটা কখনোই করা যাবে না। মা ও শিশু উভয়ের জন্যই এই শাল দুধ পান করানো অতি উত্তম।
- নবজাতক অবস্থায় শিশুর মুখের সংস্পর্শে এসে আদর করা থেকে একদম বিরত থাকা উচিৎ।
- বাইরে থেকে এসে হাত-মুখ না ধুয়ে নবজাতককের ঘরে প্রবেশ করা যাবে না।
- ছোট্ট একটি প্রাণ আমাদের সবার জীবনে নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দ। সেই আনন্দকে সব সময় ধরে রাখতে হলে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে শিশুর একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ। সেইসাথে নিতে হবে পরিপূর্ণ যত্ন। তবেই শিশুর বেড়ে উঠা নিরাপদ হবে।
Source:
http://healthtalkbd.org/newboarn_care
https://bangla.babydestination.com/how-to-take-care-of-newborn-in-summer-in-bengali
https://www.shajgoj.com/new-born-babys-winter-care-12-tips/
https://www.jagonews24.com/amp/10694
https://www.kalerkantho.com/print-edition/doctor-acen/2017/12/10/575526
https://mytonic.com/bn/child-health/tonic/%E0%A6%8F%E0%A6%87-%E0%A6%B6%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A8
https://learningfrommylife.wordpress.com/newborn/
http://m.poriborton.news/children-health/191277