উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপার টেনশন আমাদের কাছে খুবই পরিচিত এক রোগ। এই রোগ সাধারণত কয়েক বছরের চেষ্টায় আমাদের দেহে বাসা বাঁধে। অধিকাংশ মানুষ এই রোগের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন না। ফলে নীরবে আমাদের দেহে উচ্চ রক্তচাপের বিস্তার ঘটে।
তথ্য সূচী দেখুন
Toggleআবার কারো কারো ক্ষেত্রে এই রোগের কোনো পূর্ব লক্ষণ প্রকাশ পায় না৷ কিন্তু এই রোগের ফলে রক্তনালী, চোখ, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই এই রোগ সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
উচ্চ রক্তচাপ আসলে কী
আমাদের দেহের রক্তচাপ যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। রক্তনালীর মধ্য দিয়ে কী পরিমাণ রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে এবং হৃদপিণ্ড রক্ত পাম্প করার সময় কতটুকু বাধার সম্মুখীন হচ্ছে সেটাই মূলত রক্তচাপ।
ধমনী যদি সরু হয়ে যায় তাহলে রক্ত চলাচলে বাধা প্রদান করে। পাশাপাশি ধমনী সরু হয়ে আসার ফলে রক্তনালীতে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়৷ যদি দীর্ঘ সময় ধরে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে শরীরে আরো অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে হৃদরোগ হয়ে থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ যদি শুরুতেই ধরা পড়ে তাহলে খুব সহজেই একে মোকাবেলা করা সম্ভব। তাই আমাদের নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
যদি কোনো কারণে রক্তচাপ বেড়ে যায় তাহলে টানা এক থেকে দুই সপ্তাহ রক্তচাপ পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। এর মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। যত তাড়াতাড়ি এই রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হবেন তত দ্রুত এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ
উচ্চ রক্তচাপ এক ধরনের নীরব ঘাতক। অনেকের ক্ষেত্রে এই রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। কখনো কখনো এই রোগের সুস্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পেতে কয়েক বছর কিংবা এক দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়। আবার এই রোগের এমন কিছু লক্ষণ রয়েছে যা অন্য রোগের সাথে সম্পর্কিত। ফলে সেগুলো থেকে আলাদাভাবে উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ চিহ্নিত করা যায় না। তবে এই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করার আগে যেসব লক্ষণ পায়:
- প্রচণ্ড মাথাব্যথা
- নিঃশ্বাসের দুর্বলতা
- নাক দিয়ে রক্তপড়া
- অনিদ্রা
- মাথা ঘোরা
- বুকে ব্যথা হওয়া
- দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন
- মূত্রের সাথে রক্তপড়া
উপরের লক্ষণগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। হতে পারে এই লক্ষণ অন্য কোনো রোগের। তবে এক লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর আরেকটি লক্ষণের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়।
উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে মনে হয় তাহলে কিছুদিন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। পরিবারের অন্য সদস্যদের যদি রক্তচাপ থাকে, বিশেষ করে বাবা মায়ের থাকলে সন্তানেরও হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
উচ্চ রক্তচাপের প্রকারভেদ
উচ্চ রক্তচাপ সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক. প্রধান উচ্চ রক্তচাপ এবং দুই. অপ্রধান উচ্চ রক্তচাপ। উভয় প্রকার উচ্চ রক্তচাপের ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে।
প্রধান বা প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপ
এ উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয় প্রয়োজনীয় হাইপারটেনশন। এই ধরনের উচ্চ রক্তচাপ উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের শরীরে সৃষ্টি হয়৷ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের দেহেই এই ধরনের হাইপারটেনশন রয়েছে।
গবেষকরা এখনো রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং প্রাইমারি উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সুস্পষ্ট কোনো কারণ আবিষ্কার করতে পারেননি। তবে এর পেছনে সম্ভাব্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়ে থাকে। তবে সেগুলো একেবারে সুনিশ্চিত প্রাইমারি হাইপারটেনশনের কারণ নয়।
- জিন: অনেকের জিনগত কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়। পিতামাতার কাছে থেকে পাওয়া জিন থেকে অনেকের এই রোগ হয়।
- শারীরিক পরিবর্তন: আমাদের দেহের কোনো একটি অংশ যদি পরিবর্তিত হয়, তাহলে সেটা আমাদের দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায়। প্রাইমারি হাইপারটেনশনও এমন কোনো শারীরিক পরিবর্তনের ফলে হয়ে থাকতে পারে।
- পরিবেশ: মাত্রাতিরিক্ত কাজ, অনিষ্টকর জীবনযাপন, শারীরিক ব্যায়ামের ঘাটতি এবং বাজে ডায়েটের কারণে হাইপারটেনশন হতে পারে। বিশেষ করে খারাপ জীবনযাপন পদ্ধতির কারণে আমাদের দেহের ওজন বৃদ্ধি পায়। আর অতিরিক্ত ওজনের কারণে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন
সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন খুবই দ্রুত ঘটে এবং প্রাইমারি হাইপারটেনশনের চেয়ে তা খুবই বিপদজনক। বিভিন্ন কারণে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন হতে পারে। উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে রয়েছে:
- কিডনির সমস্যা
- অবসট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া
- হৃদরোগের সমস্যা
- থাইরয়েডের সমস্যা
- ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- মাদক গ্রহণ
- মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান
- মূত্রগ্রন্থির সমস্যা
- এন্ডোক্রাইন টিউমার
উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় পদ্ধতি
উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় করা খুবই সহজ। রক্তচাপ পরীক্ষার মাধ্যমে অতি সহজেই এই রোগ নির্ণয় করা যায়। তবে একবার বা দুইবার রক্তচাপ মেপে রক্তচাপের সমস্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
যদি স্বাভাবিকের চেয়ে রক্তচাপ বেশি হয় তাহলে টানা এক সপ্তাহ তা মেপে দেখতে হবে। যদি কোনো উন্নতি না হয় তাহলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য চিকিৎসকরা কিছু পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। চিকিৎসকরা সাধারণত যেসব পরীক্ষা করতে দিয়ে থাকেন:
- মূত্র পরীক্ষা
- কোলেস্টেরল স্ক্রিনিং
- রক্ত পরীক্ষা
- ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইকেজি/ইসিজি)
- হৃদপিণ্ড ও কিডনির
- আল্ট্রাসোনোগ্রাফি
বিভিন্ন প্রকারের ব্লাড প্রেসার রিডিং
রক্তচাপের বিভিন্ন পাঠ থেকে উচ্চ রক্তচাপের ধরন সম্পর্কে খুব সহজেই ধারণা পাওয়া সম্ভব। রক্তচাপের পাঠ মূলত দুইটি সূচকে প্রকাশ করা হয়। উচ্চ সূচককে বলা সিস্টোলিক প্রেসার। আর নিম্নের সূচককে বলা হয় ডায়াস্টোলিক। মূলত ব্লাড প্রেসারের পাঠকে পাঁচভাগে ভাগ করা হয়।
স্বাস্থ্যকর রক্তচাপ: রক্তচাপ যদি ১২০/৮০ হয় তাকে স্বাস্থ্যকর রক্তচাপ বলে।
উচ্চ রক্তচাপ: সিস্টোলিক পাঠ যদি ১২০-১২৯ এবং ডায়াস্টোলিক পাঠ যদি ৮০ এর কম হয় তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। তবে এ ধরনের রক্তচাপের জন্য চিকিৎসকরা কোনো ঔষধ প্রদান করেন না। এক্ষেত্রে তারা লাইফস্টাইল পরিবর্তন করার কথা বলে থাকেন।
হাইপারটেনশন স্টেজ ওয়ান: সিস্টোলিক পাঠ ১৩০-১৩৯ এবং ডায়াস্টোলিক পাঠ ৮০-৮৯ হয় তাকে স্টেজ ওয়ান হাইপারটেনশন বলা হয়।
হাইপারটেনশন স্টেজ টু: সিস্টোলিক পাঠ ১৪০ বা তার বেশি এবং ডায়াস্টোলিক পাঠ ৯০ বা তার বেশি হলে তাকে হাইপারটেনশন স্টেজ টু বলা হয়।
হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিস: সিস্টোলিক পাঠ ১৮০ এর বেশি এবং ডায়াস্টোলিক পাঠ ১২০ এর বেশি হলে তাকে হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিস বলা হয়। এই মাত্রার রক্তচাপের ক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। যদি রোগীর মাথাব্যথা, বুকে ব্যথা, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা এবং নিঃশ্বাসে হয় তাহলে তাকে দ্রুতে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা
বিভিন্ন সূচকের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকরা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে রোগীর কোন ধরনের হাইপার টেনশন রয়েছে এবং তার পেছনের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর চিকিৎসকরা সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করে থাকেন।
যদি কোনো রোগী প্রাইমারি হাইপারটেনশন থাকে তাহলে চিকিৎসকরা তাকে লাইফস্টাইল পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাতে যদি কোনো কাজ না হয় তখন চিকিৎসকরা ঔষধ দিয়ে থাকেন।
অন্যদিকে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনের চিকিৎসা হিসেবে শুরু থেকেই নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ দেওয়া হয়। ঔষধ খাওয়ার পর রক্তচাপের গতিবিধি দেখে চিকিৎসকরা ঔষধ পরিবর্তন কিংবা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ
উচ্চ রক্তচাপের জন্য বাজারে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ রয়েছে। তবে আগে নিশ্চিত হতে হবে কোন ঔষধ রোগীর দেহের সাথে কার্যকর হচ্ছে। সেই অনুযায়ী
চিকিৎসকরা ঔষধ নির্ধারণ করে থাকেন৷ এই রোগের জন্যে চিকিৎসকরা সাধারণত যে সকল ঔষধ প্রদান করে থাকেন:
বেটা-ব্লকার (Beta-blockers): বেটা-ব্লকার হার্টবিট ধীর করে দেয় এবং হার্টের চাপ কমায়। ফলে প্রতিবার হার্টবিট করার সময় আগের চেয়ে কম রক্ত পাম্প করে। ফলে রক্তচাপ কমে যায়। একই সাথে এই ঔষধ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে এমন হরমোনের তৈরির গতিকে হ্রাস করে দেয়।
ডাই-ইউরেটিকস (Diuretics): শরীরের উচ্চ মাত্রার সোডিয়াম এবং অতিরিক্ত তরল রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। ডাই-ইউরেটিকস নামের এক ধরনের ট্যাবলেট খাওয়ার ফলে শরীরের অতিরিক্ত সোডিয়াম কিডনি মাধ্যমে বের হয়ে যায়।। সোডিয়াম বের হয়ে যাওয়ার পর অতিরিক্ত পানি মূত্র হিসেবে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। যার ফলে রক্তচাপ কমে যায়।
এসিই ইনহিবিটর্স (ACE inhibitors): অ্যানজিওটেনসিন নামে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ আমাদের রক্তনালী ও ধমনীকে শক্ত ও সরু করে দেয়। ফলে এসিই (অ্যানজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম) ইনহিবিটর্স দেহে অ্যানজিওটেনসিন উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ফলে রক্তনালী শিথিল থাকে এবং রক্তচাপ কমে যায়।
অ্যানজিওটেনসিন টু রিসেপটর ব্লকার (Angiotensin II receptor blockers [ARBs]): এসিই ইনহিবিটর্স অ্যানজিওটেনসিনে উৎপান কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে এআরবি অ্যানজিওটেনসিনকে তার রিসেপটরদের সাথে বন্ধন সৃষ্টিতে বাধা দেয়।
ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (Calcium channel blockers): এই ঔষধ হৃদপিণ্ডের অভ্যন্তরে ক্যালসিয়ামের প্রবেশে বাধা প্রদান করে। ফলে হৃদযন্ত্র কম চাপে হার্টবিট করে। এতে করে রক্তচাপ কমে যায়। এই ঔষধ রক্তনালীকে কিছুটা শিথিল করতে সাহায্য করে।
আলফা-২ অ্যাগোনিস্ট (Alpha-2 agonists): এই ঔষধ স্নায়ু তাড়না পরিবর্তন করে দেয়। যা সাধারণত পূর্বে রক্তনালিকে শক্ত করে দেয়। এই ঔষধ নেওয়ার পর রক্তনালি শান্ত থাকে এবং রক্তচাপ কমে যায়।
উচ্চ রক্তচাপের ঘরোয়া চিকিৎসা
উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা সুস্থ জীবনচর্চা। অর্থাৎ সঠিক লাইফস্টাইল মেনে চলা। তবে এর পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা
খাবারের তালিকায় এমন সব খাবার রাখতে হবে যা হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী। এতে করে হৃদপিণ্ড ভালো থাকার পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। একই সাথে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও বিভিন্ন হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এজন্য প্রচুর পরিমাণ ফল, শাকসবজি, শস্যদানা এবং মাছ খেতে হবে।
দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ
অতিরিক্ত ওজন রক্তচাপ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অবশ্যই ওজন কমাতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্যকর ডায়েট ও কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
কায়িক পরিশ্রম বৃদ্ধি
দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কায়িক পরিশ্রম আবশ্যক। পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস দুশ্চিন্তা কমানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। একই সাথে হৃদরোগকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। এ কারণে সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। অর্থাৎ সপ্তাহের পাঁচদিন গড়ে আধা ঘণ্টা। তবে এর পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে রক্তচাপ তত বেশি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
মানসিক চাপের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। এ কারণে যেকোনো মূল্যে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যায়ামের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাশাপাশি ধ্যান, দীর্ঘ নিঃশ্বাস, ম্যাসেজ, পেশি শিথিলকরণ এবং যোগব্যায়ামের মাধ্যমে মানসিক অবসাদ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার
উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর ধূমপানের অভ্যাস থাকলে অবশ্যই তা পরিহার করতে হবে। কারণ তামাক দেহের টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রক্তনালীকে শক্ত করে। পাশাপাশি মদপানের অভ্যাস থাকলে সেটাও পরিহার করতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ডায়েট
রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করার সহজ পন্থা হলো স্বাস্থ্যকর ডায়েট৷ তার জন্য প্রয়োজন আহারে সঠিক খাবার বেছে নেওয়া। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ডায়েট যেমন হওয়া উচিত:
মাংস কম, সবজি বেশি
শাকসবজি নির্ভর ডায়েট শরীর ফাইবার বৃদ্ধি করে সোডিয়াম এবং ক্ষতিকর আনস্যাচুরেটেড ও ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ কমায়। মাংসের পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে ফল, শাকসবজি, শস্যদানা ও সবুজ লতাপাতা খেতে হবে। প্রোটিনের ঘাটতি পূরণের জন্য লাল মাংসের পরিবর্তে মাছ, পোলট্রি ও টফু খেতে হবে।
সোডিয়াম খাওয়া কমাতে হবে
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে যারা প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২৩০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম গ্রহণ করেন তারা বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। ডায়েটে সোডিয়ামের পরিমাণ কমানোর জন্য খাবার সতেজ থাকা অবস্থায় রান্না করে খাওয়া উচিত। রেস্টুরেন্ট এবং প্যাকেটজাত খাবার পরিহার করা উত্তম।
মিষ্টি পরিহার
চিনি জাতীয় খাবার এবং বেভারেজে পুষ্টিকর কোনো খাদ্য উপাদান নেই। সুস্থ থাকতে হলে এসব খাবার পরিহার করতে হবে। যারা মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন তারা সতেজ ফলমূল অথবা সামান্য পরিমাণে চিনিছাড়া ডার্ক চকোলেট খেতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত ডার্ক চকোলেট খাওয়ার ফলে রক্তচাপ কমে।
গর্ভবতী নারীদের করণীয়
উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও গর্ভবতী নারীরা সুস্থ সবল বাচ্চা জন্মদান করতে পারেন। তবে বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় তাকে অবশ্যই নিয়মিত রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সতর্কতার সাথে চলাফেরা করতে হবে। গর্ভবতী নারীদের রক্তচাপের সমস্যা থাকলে তাদের কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এর ফলে অনেকের বাচ্চার ওজন কম হয় অথবা অকালে বাচ্চা প্রসব করেন।
অনেক নারীর গর্ভবতী থাকার সময় উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। এতে উচ্চ রক্তচাপ জনিত বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। গর্ভবতী অবস্থায় এই রোগ হলে পরবর্তীতে তা বৃদ্ধির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ
উচ্চ রক্তচাপকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়৷ একে শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে চাইলে এই রোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে তার জন্য প্রয়োজন বিশেষ কিছু পদক্ষেপ। যেমন:
- স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেনে চলা
- মাংস পরিহার করে প্রচুর পরিমাণ
- মাছ, শাকসবজি ও সালাদ খাওয়া
- চিনি পরিহার করা
- ওজন কমানোর জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা
- নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা।
রক্তচাপ নিয়ে যত ভুল ধারণা
রক্তচাপ বাড়লে ঘাড়ব্যথা হয়
ঘাড়ে ব্যথা হলে কেউ কেউ মনে করেন, নিশ্চয়ই রক্তচাপ বেড়েছে। এই ধারণা অমূলক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্তচাপ বৃদ্ধির কোনো উপসর্গ বোঝা যায় না। সাধারণত হাড়ের জোড়া বা সন্ধির সমস্যায় ঘাড়ব্যথা হয়ে থাকে।
রক্তচাপ বেশি থাকলে দুধ-ডিম নিষেধ
দুধ-ডিম-মাংস খেলে রক্তচাপ বাড়ে—এমন ধারণা ভুল। রক্তচাপ বেড়ে গেলে অনেকে দুধ-ডিম খাওয়া ছেড়ে দেন। কিন্তু আসলে লবণ বা লবণাক্ত খাবার বেশি খেলে রক্তচাপ বাড়তে পারে। মূলত হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তেল-চর্বিযুক্ত খাবার, যেমন ডিমের কুসুম, দুধের সর, চর্বিযুক্ত মাংস ইত্যাদি খেতে নিষেধ করা হয়।
টক খেলে রক্তচাপ কমে
এই ধারণাও ভুল। রক্তচাপের পরিমাণ বেশি দেখলে কেউ কেউ তেঁতুলের পানি বা টক খান। লবণ মিশিয়ে এসব খেলে রক্তচাপ আরও বাড়তে পারে। আর লবণ ছাড়া খেলে অ্যাসিডিটির সমস্যা হয়।
লবণ ভেজে খাওয়া যাবে
উচ্চ রক্তচাপের জন্য কাঁচা লবণ খেতে নিষেধ করায় অনেকে লবণ হালকা ভেজে খান বা রান্নায় লবণের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। কিন্তু লবণ যেভাবেই খান না কেন, তা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেবে।
রক্তচাপ কমলে ওষুধ নয়
উচ্চ রক্তচাপের অনেক রোগী রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকলে ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেন, যা একেবারেই ঠিক নয়। উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এমনকি জীবনের ঝুঁকিও থাকে।
সমস্যা নেই বলে ওষুধ বাদ দেবেন
রক্তচাপ বাড়তি থাকলেও শরীরে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, এমন অজুহাতে কেউ কেউ ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে চান। আসলে উচ্চ রক্তচাপে তেমন কোনো উপসর্গ না থাকলেও এটি ধীরে ধীরে হৃদরোগ, পক্ষাঘাত, দৃষ্টিহীনতা ও কিডনি অকার্যকারিতার ঝুঁকি বাড়াবে।
দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এড়াতেই আপনাকে ওষুধ দেওয়া হয়। অনেকে বলেন, এই ওষুধ শুরু করলে সারা জীবন খেতে হবে, তাই শুরু না করাই ভালো। এটাও বিপজ্জনক চিন্তা। প্রয়োজন হলে ওষুধ অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা উচিত, নয়তো জটিলতা বাড়বে।
রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণ টেনশন
মানসিক চাপ, উদ্বেগ ইত্যাদি কিছুটা দায়ী বটে। তবে কেবল মানসিক উৎকণ্ঠা উচ্চ রক্তচাপের একমাত্র কারণ নয়।
অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন, ওজনাধিক্য, ধূমপান, মদ্যপান, তেল-চর্বিজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ প্রভৃতি উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। জীবনাচরণ পরিবর্তন করে রক্তচাপ বাড়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমাতে পারবেন।
অন্যের ওষুধে ভালো কাজ হয়
উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে আপনার বয়স, উচ্চ রক্তচাপের তীব্রতা, আনুষঙ্গিক অন্য রোগ (যেমন ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস, হাঁপানি, প্রোস্টেটের সমস্যা, গর্ভাবস্থা ইত্যাদি) অনেক বিষয় বিবেচনা করেই রক্তচাপ কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়।
কোনো ওষুধ কারও জন্য প্রয়োজনীয়, আবার একই ওষুধ অন্য কারও জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই যে ওষুধে অন্যের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এসেছে, সেটা আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়ার চিন্তাও করবেন না।
Source: https://www.healthline.com/health/high-blood-pressure-hypertension?ref=global#preventing-high-blood-pressure
https://www.prothomalo.com/amp/life-style/article/1068191/%E0%A6%89%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9A-%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%AA-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A7%AE-%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A6%BE
1 Comment
Awesome post about us